নিজের সঙ্গে থাকতে চাওয়া কি একান্তই অপরাধ? সব সময় কি লোকজন সংসর্গে থাকতেই হবে ? কোনোভাবেই থাকা যায় না কি একা ? একদম একা, নিজের সঙ্গে একা ?
"… আমি আমার বাবার জমি ডিঙিয়ে কোনও বাড়ি বা শহরে যেতে পারি না," এমিলি ডিকিনসন লিখছেন তাঁর চিঠিতে, আর এই চিঠি লেখা হয়েছে লেখক, অবলিশনিস্ট ও সৈনিক কর্নেল থমাস ওয়েন্টওয়ার্থ হিগিনসনকে। একটি চিঠির জবাবে তাঁকে এরকমটা লিখেছিলেন এমিলি। তাঁকে হিগিনসন তিনবার বোস্টনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, বিভিন্ন সাহিত্য বক্তৃতাগুলিতে অংশগ্রহণ করা এবং অন্যান্য কবিদের সাথে সাহিত্যের আলোচনার জন্য সাক্ষাৎ। হিগিনসনের সঙ্গে এমিলি যোগাযোগ রাখতেন নিয়মিতই, তিনি ছিলেন বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম, যার সাথে তিনি তাঁর কবিতাও ভাগ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি তাঁর আমন্ত্রণগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, এমনকি অন্য সমসাময়িক কবিদের সাথে দেখাও করতে চাননি।
এমিলি ডিকিনসন Image Courtesy : wikipedia.org |
সমস্ত মহিলারা নাকি বিপজ্জনক! আমরা যদি বেশিরভাগ ট্রাডিশনাল টেক্সটগুলিতে একটু চোখ বোলাই তাহলেই একথার সত্যতা যাচাই করা হয়ে যায়। বিশেষত যদি অনুসরণ করি পুরুষদের লেখাগুলিকে, অদ্ভুত এক বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে মেয়েরা! আর সবথেকে বেশি আলোচিত হয়েছে একা মেয়েদের যাপন ! সম্ভবত একাকী মহিলারা সবচেয়ে বিপজ্জনক ! বা কমপক্ষে, তাদের দিকে প্রশ্ন তোলা বড্ড সহজ, গোটা সমাজের চোখটা হয় খুব সরু আর ছুঁচোলো হয়েছে কিংবা বড় বড় চোখ করে তাকাতে হয়েছে তাদের দিকে ! সবার থেকে বিস্ময়কর এক প্রাণী, সবার থেকে অবাক করা এক প্রাণী, একা -একদম একা -একদম শুধুমাত্র নিজের সঙ্গে থাকতে চাওয়া একটা মেয়ে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা, যার স্বামী নেই, সন্তান নেই এবং নেই কোনও পরিবার, এ জাতীয় মহিলারা সমাজের অবাক দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন সব সময়েই। এই নারীরা নাকি অস্বাভাবিক, সামাজিক মেলামেশা থেকেও বিরত থাকেন নাকি তারা ? এমন ধারণা উদ্ভূত হয়। কোনো নারী যদি নির্জনতা উপভোগ করেন, প্রকৃতির মধ্যে নিজ- অস্তিত্ব, সত্ত্বাকে খুঁজে নিতে যান, তাহলে কি তিনি অবিশ্বাসের যোগ্য ? সমাজ তাকে বিচ্ছিন্ন করে নিজ মানদণ্ডের ভিত্তিতে। কারণ সেই একা নারীর নিয়ম সম্ভবত সমাজ - নিয়ম বহির্ভূত, স্বাভাবিক ক্রমের ক্ষেত্রে একটি বাধাস্বরূপ।
এমিলি ডিকনসন এই সমস্ত মানদণ্ড পূরণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
যৌবনে ডিকিনসনের একটি নিজস্ব সামাজিক বৃত্ত ছিল। এবং একজন বাগদত্তও ছিল। কিন্তু তার জীবনবৃত্তের শেষভাগে পৌঁছে , তিনি বিচ্ছিন্নতার দিকে আরও বেশি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। যদিও তিনি ঘরোয়া কাজগুলি অপছন্দ করতেন চিরদিনই, কিন্তু ডিকিনসন পরবর্তীতে নিজেকে বাড়ির কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন; বেকিং, বাগান-পরিচর্যা, সেলাইয়ের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, আর ছিল তার কুকুর কার্লো। তার জীবনের বাকি দিনগুলিতে, তিনি বেশির ভাগ সময় কাটাতেন তাঁর নিজের ঘরে লেখার ছোট্ট টেবিলটিতে, সামনে জানালা, প্রকৃতির আবছায়া সৌন্দর্য্য গাঢ় হতে শুরু করেছে তাতে। জীবদ্দশায় প্রায় ১৮০০ টি কবিতা লিখেছিলেন, এবং প্রায় ১০০ জন সাংবাদিককে চিঠি লিখেছিলেন এই জানালার ধারে বসেই ।
এমিলি ডিকিনসনের ম্যানুস্ক্রিপ্ট : “Wild Nights-Wild Nights!”. Image Courtesy : Emily Dickinson archive
চিঠি এবং কবিতা এমিলির লেখাকে করেছিল পরিণত, নিজেকে লেখার মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন এমিলি। লক্ষ্য ছিল লেখার দক্ষতা অর্জন করা। অতিরিক্ত সময়টাতেই কেবলমাত্র সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে অংশ নিতেন তিনি। দিনের বাকি সময়টা গচ্ছিত রেখেছিলেন লেখার কাছেই। উনিশ শতকের এক মহিলার পক্ষে এটা একটু অবাক করা কথা তো বটেই, কারণ সেই সময় বেশিরভাগ আধুনিক মহিলারাও গৃহকর্ম নিয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন, শিল্পচর্চা করার মতো মূল্যবান সময়টি স্বাভাবিকভাবেই সীমিত ছিল। এমিলির ক্ষেত্রেও সত্যি হতে পারত এটা।
ডিকিনসনের অপরাধ কেবল র্যাডিক্যাল কবিতা ছিল না, তাঁর একা থাকতে পছন্দ করা, এবং চিঠিপত্রের মাধ্যমে বেশিরভাগই সামাজিক মেলামেশা করা - সেটাও ছিল। এই পছন্দের কারণটি তাঁর কথায়, তাঁর লেখায় খুঁজে পাওয়া যাবে, সময়ের প্রবাহের ঠিক বিপরীতে অবস্থান তাঁর। এমিলি ডিকিনসন ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন রেবেল। একজন সত্য বিদ্রোহীর মতো তিনিও স্বাধীনতার বা স্বাধীন-চেতনার উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বরাবরই। ক্ষমতা এবং চিরাচরিত মতবাদের প্রতি তার তীব্র বিদ্বেষ ছিল। এটা স্পষ্ট যে তিনি তার সামাজিক সীমাবদ্ধতা বা পরিধি সম্পর্কে ভালভাবেই জানতেন এবং তিনি প্রায়শই এই "পরিধি-বেষ্টন " -“Circumference ''পরীক্ষা করেছিলেন কৌতূহলের সীমায়িত ছন্দে।
ডিকিনসন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি নিজের বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলে এই স্বাধীনতা অতিমাত্রায় বজায় রাখতে পারবেন না । সমাজ - আবদ্ধ অন্য্ আরেকটি বেষ্টনীর মধ্যে পড়তে হবে তাকে। সেখান থেকে শুরু হবে এক ভাসা ভাসা স্বাধীনতার গল্প। তিনি সবসময় এমন স্থান নিজের মধ্যে কল্পনা করতে থাকতেন যা তিনি তার জীবদ্দশায় বা বলা ভালো কখনও বাস্তবিক জীবনে দেখতে পাবেন না। তাই তিনি নিজের কল্পনাশক্তি ও কবিতার মাধ্যমে এই অসম্ভব ও অবাস্তব দৃশ্যগুলি পরিদর্শন করেছেন বরাবরই । মনের মধ্যে বুনে নিয়েছেন, “wild, wild nights” এবং একদিন ভোরবেলা তিনি আর তার পোষ্যটি চলে গিয়েছেন- “and visited the sea” . কিন্তু এমিলি ডিকিনসন কখনও সমুদ্র দেখেননি সারাজীবনে ।
তবে সময় ও জায়গার সীমানা ডিকিনসন অস্পষ্ট করে তুলেছেন এমন নয়। তিনি আরও জানতেন যে তিনি কখনই সত্যিকার অর্থে মানুষজনের ভিড়ে নিজেকে নিয়ে থাকতে পারবেন না। তাই তার ঘরের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই , তিনি তার জেন্ডার এবং সেক্সসুয়ালিটি নিয়ে করেছেন বিস্তর ভাবনাচিন্তা। কবিতার লাইনগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন নিজের সঙ্গেই, কখনও কখনও তাদের নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন, কখনও বা এড়িয়ে গেছেন নিজের কাছেই। যেমনভাবে করেছিলেন তাঁর অর্থপূর্ণ কবিতাগুলিকে। এবং অন্যান্য সময়ে, অস্বাভাবিক রকমের মাথা ঘামিয়েছেন, বলতে গেলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন বিষয়গুলিকে নিয়ে। যেমন সুসান হান্টিংটন ডিকিনসন বা সুসির কাছে তার সুস্পষ্ট,সুব্যক্ত এবং বিশদে লেখা চিঠিগুলিতে দেখা যায়। তার ঘরটিই ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে কোনও নিয়ম জারি করবার কেউ ছিল না। ছিল না কোনও বিষয়ে রায়দান করবার অন্য্ কোনও মানুষ। কেবল এমিলির কথাই সত্যি ছিল সেখানে, ছিল পূর্ন স্বাধীনতা। বাইরের জগৎ নয়, এমিলির ঘরই তাকে দিয়েছিল স্বাধীনতা আস্বাদনের পূর্ণ সুযোগ। পূর্ণ ভাবনাচিন্তার অবসর ও অবকাশ।
আর সবথেকে অদ্ভুত এই যে, তাঁর এই নির্জনপ্রিয়তা, নিঃসঙ্গযাপন আর একাকিত্বের প্রতি এই অপার ভালবাসার আকুল আকাঙ্ক্ষা এবং অবাধ স্বাধীন-মনন ইচ্ছার জন্য , তিনি তাঁর প্রথম দিকের প্রকাশকদের দ্বারা অপমানিত হয়েছিলেন, - যারা আজও আমাদের মনে ডিকিনসনের এক আলাদা চিত্র তৈরিতে সহায়ক-সঙ্গতের ভূমিকা পালন করে। আর সেই ছবিতে আমাদের মনশ্চক্ষে ভেসে আসে এক ছবি- বিচ্ছিন্ন, একা এক নারী, সম্ভবতঃ সমাজ নিয়ম থেকে তিতিবিরক্ত, সাদা রঙের ঢিলে এক গাউন পরিহিত, ছোট্ট এক লেখার ডেস্কে বসে এক টুকরো কাগজের উপর হিজিবিজি কেটে চলেছে।
ধারণা কি করা যেতে পারে যে, তিনি আসলে একটি সম্ভাব্য হৃদয়ভঙ্গের কাহিনীর পরিসমাপ্তির পরে তিনি বিচ্ছিন্ন করেছেন নিজেকে? হয়তো, নিজের সঙ্গে একা হওয়ার এই স্বেচ্ছাকৃত পছন্দটি কোনও নারীর পরোক্ষে বা প্রত্যক্ষে যুক্তি গঠনে সচেষ্ট থাকে।
পাবলো পিকাসো বলেছিলেন, “Without great solitude, no serious work is done.”- নির্জনতা ব্যতীত কোনো গুরুত্ত্বপূর্ন কাজ অসম্ভব। পিকাসো খুব সম্ভবত তাঁর জীবনের শেষদিকে একটি বিশৃঙ্খল জীবন-যাপন করতেন। যদিও একা এবং ধ্যানমগ্ন পুরুষ, বলতে গেলে একা এবং ঈষৎ বিশৃংখল পুরুষ তার যুগপৎ ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ এবং মুগ্ধতার বিষয়বস্তু সমাজের কাছে, কিন্তু ঠিক তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কোনো একা থাকতে চাওয়া নারী সম্ভবত মধ্যযুগীয় বিচার-ব্যবস্থার শিকার হয়, প্রায় কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তাকে। জীবন-পণ করে নিজের মনের উপর ঝুঁকি নেয় তারা। পুড়ে যায় জীবন, পুড়তে থাকে মন। আজও তাকে এক অদ্ভুত অবস্থানে চিহ্নিত করা হয়।
এমিলি ডিকিনসনের ব্যক্তিত্বের নতুন ব্যাখ্যা হয়েছে, গবেষকরা বুঝতে চেয়েছেন তাকে বিভিন্ন ভাবে। রিইন্টারপ্রিটেশন হয়েছে, দেওয়া হয়েছে অনেক ব্যাখ্যা - বিশ্লেষণ। তবুও নির্জনতার ছাপ থেকে যায়। সঞ্চারিত হয় গভীর নির্যাতনের, গভীর মানসিক আঘাতের চিহ্ন। তাকে পুরোপুরি ছেড়ে যেতে অস্বীকার করে। ডিকিনসনের প্রচুর চিঠি আবিষ্কার করা গেছে, তার বহুল চিঠিপত্র সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, তার লেখাগুলি ইঙ্গিত করে তাঁর মন এবং অন্তরাত্মার স্বাধীনতার দিকে। তার পরেও কি তিনি মেনে চলতে পারতেন সমাজ-অনুশাসন।তাঁর পরম করুণাময়ী, নির্জনবাসিনী সন্ন্যাসিনী, সহমর্মী ভাবমূর্তির আভাসই আমাদের মনশ্চক্ষে পরিলক্ষিত হতে থাকে।
সম্ভবত "একা এক নারী" নামক বিষয়বস্তু সমাজের নিজস্ব কিছু নিয়ম নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সমাজের কিছু ফিক্সেশন আছে নারীদের রকম-সকম, আচার-ব্যবহার, উঠা-বসা, থাকে-না-থাকে নিয়ে ! এমিলি ডিকিনসন ও তাঁর জীবনযাপনও তার ব্যত্যয় ছিল না। অসাধারণতার সাথে সমাজের স্থিরতার পুরো বিপ্রতীপের ইঙ্গিত যা। এটাকে কি বিপণনের এক প্রখর বুদ্ধিসম্মত কৌশল বলা যেতে পারে ? এই চিত্র কি কাব্য-অনুরাগীদের ও কবিতা উৎসাহীদের আগ্রহকে চিহ্নিত করার এক সুকৌশল প্রয়াস ? যদি এটাই সত্যি হয়ে থাকে, তবে অস্বীকার করা যায় না যে তা খুব কাম্য বা সঠিকও নয়।
একদিন ডিকিনসনের ভাইজি মার্থা এমিলির শোবার ঘরে এসেছিল। এমিলি কল্পিত চাবি দিয়ে দরজাটি তালাবদ্ধ করার ভান করেছিলেন এবং তারপরে ভাইজির দিকে ফিরে বলে উঠেছিলেন, "ম্যাটি, এখানে স্বাধীনতা।"
ডিকিনসন এবং আরো অনেক নারীর জীবনে নির্জনপ্রিয়তার ধারণা এবং এক নারীর স্বাতন্ত্র্যের , স্বাধীনতার প্রতি অফুরান ভালোবাসার আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আপাতদৃষ্টিতে সমাজের কাছে মৌলবাদী বলে বোধ হয়। মূলগত অসাযুজ্য বলে বোধ হয় সমাজের কাছে। সমাজের দৃষ্টিতে তা সহজাত প্রবৃত্তি নয়। মূলানুগ ধারণার পরিপন্থী একা নারীর যাপন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন