এমিলি ডিকিনসন। মার্কিন এই কবির লেখা চিঠিতে পাই মৃত্যু নিয়ে অনেক কথা ।
আমেরিকান কবি মেগান ও’রউর্ক তার মাকে হারানোর স্মৃতিতে লিখেছেন , “আমরা যাদের ভালোবাসি তারা যেন আমাদের শরীরের অংশ হয়ে রয়ে যায়, আমাদের সিনাপসেস এর মতো করেই জুড়ে রাখে , যে পথে, যে স্মরণীতে স্মৃতি তৈরি হতে থাকে। ” মায়ের মৃত্যুর পর এমনিই কিছু অনুভবের কথা জানিয়েছেন আরও একজন কবি প্রায় এক শতাব্দী আগে। বয়ান পাই তার মায়ের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া প্রসঙ্গে। বিরল এক দার্শনিক চেতনার প্রতিফলন থেকে যায় সেই মরমিয়া গদ্যে।
এমিলি ডিকিনসন; Image Courtesy : wikipedia.org |
এমিলি ডিকিনসনের (ডিসেম্বর ১০, ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ - মে ১৫, ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ ) মা যখন মারা যান , তখন তার বয়স বাহান্ন। তার আট বছর আগে একটা স্ট্রোকে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন এমিলির মা । পক্ষাঘাতগ্রস্থ। প্রায় পুরোপুরি অক্ষম হয়ে গিয়েছিলেন তিনি । আজীবন শারীরিক অসুস্থতা তাকে করে তুলেছিল তিতিবিরক্ত । ভুগতে থাকা শরীর -তার সঙ্গে-মনকেও বিপর্যস্ত করেছিল। নিজের জীবন ঘিরে চরম অনাগ্রহ, হতাশা আর বিসদৃশ রকমের বিরক্তি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তাঁর কন্যার প্রতি ছিলেন বরাবরই মনোযোগী। এক দমবন্ধ করা অসুখী পরিবেশ ডিকিনসন পরিবারে; এমিলি নরক্রস ডিকিনসন - মায়ের নামেই রাখা হয়েছিল এমিলির নাম - ছিলেন এক স্নেহশীল মা। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে আগ্রহ জন্মেছিল কবির, উৎসাহিত করেছিলেন মা তাঁর এই অদম্য আগ্রহকে। বাড়ি ঘিরে এক মনোরম স্মৃতি কাজ করত এমিলির মনে। তাকে যে লিখতে হবে "বাড়ি একটি পবিত্র স্থান ।" বাড়িতে ছিল যে মায়ের স্মৃতি।
যদিও ডিকিনসনের প্রায় ১৭৭৫ টি কবিতায় মৃত্যুর বিষয়ে প্রত্যক্ষ করা যায় এক গভীর চিন্তন -রিফ্লেক্টিভ থট। বিভিন্ন মাত্রায় কিংবা সোজাসুজি একমাত্রিক। কিন্তু তাঁর মায়ের মৃত্যু পুরোপুরি আলাদা এক ক্রমে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। মুখোমুখি হতে হয়েছিল - প্রতীকি ও অনুমান- নির্ভার অ্যাবস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত চিন্তনের চেয়েও তা ছিল তাৎপর্যময় । এক ধরণের আকস্মিক,তীব্র নিরাপত্তাহীনতায় খুঁজতে হয় সেই ক্ষতির ন্যূনতম হিসাব ।
১৮৮২ সালের নভেম্বরে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পরপরই তার তুতো ভাইদের কাছে লেখা একটি চিঠিতে কবি লিখেছেন - এই চিঠিটি পাওয়া যায় এমিলি ডিকিনসনের চিঠির সংগ্রহে :
'' মা মারা যাওয়ায় আমার অবস্থা প্রায় হতচকিতের মতো হয়ে গিয়ে ছিল, ... সে যেন আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পিছলে চলে গেল, যেমন করে বাতাসের মধ্যে জড়ো হওয়া হালকা কুঁড়ো গুলো উড়ে চলে যায় "অসীম" নামে এক অনন্ত প্রবাহের অংশ হয়ে । আমরা জানি না তিনি এখন কোথায়, যদিও অনেকে অনেক কথা আমাদের বলেন। ''
এমনকি ছোটবেলায়, এমিলি অমরত্ব সম্পর্কে ছিলেন যথেষ্ট সন্দিহান , প্রকাশ করেছিলেন তার এই সন্দেহের কথাও। তাই তার গুরুজনদের ক্যালভিনিজমের মূলতত্ত্বের গোড়ামিটুকু বর্জন করেছিলেন দৃঢ়তার সাথে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নিজেকে -কুসংস্কারের থেকে দূরে থাকার । "কুসংস্কার এবং ধর্ম বিশ্বাসের উপদেশগুলির উপর অবিশ্বাস সংক্রান্ত লেখাগুলি আমাকে চিরকালই আকর্ষণ করেছে " - মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে তিনি লিখছেন সুসান গিলবার্টকে - তাঁর প্রথম প্রেম এবং আজীবনের প্রাণের বন্ধু। ডিকিনসন প্রথাগত চিরাচরিত ধর্মবিশ্বাসকে এবং ঈশ্বরসংক্রান্ত সমস্ত প্রচলিত ব্যবস্থাপনাকে করেছিলেন প্রত্যাখ্যান , যোগ দেননি কখনও কোনও গির্জার প্রার্থনা সংগীতে। তিনি বিশ্বাস করতেন অনন্ত নিঃসীম শূন্যতাকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী মারিয়া মিচেলের প্রতি গ্রহণ করেছিলেন আত্মার আত্মীয়তা, আত্মার গভীর বন্ধুত্ত্ব । এই মানসিকতা আর দৃষ্টিভঙ্গিই দেখি তাঁর চিঠিতে , তার তুতো ভাই-বোনেদের লেখা চিঠিতে :
"...আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের নির্মানকর্তা এক এক রকমভাবে জীবনকে দিয়েছেন আমাদের উপভোগ করার জন্য - যিনি আমাদের এই অসামান্য পৃথিবীকে দিয়েছেন, সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীকে, আর এই পৃথিবীর রয়ে গেছে বিস্মিত করার মতো শক্তি। এর বাইরে রয়েছে এক নিঃস্তব্ধতা ''।
এমিলি নরক্রস ডিকিনসন Image Courtesy : wikipedia.org |
নিজের অকাল মৃত্যুর প্রায় চার বছর আগে, তিনি এই চিঠিটি শেষ করেছেন এই ভাবে :
" কেমন লাগে এই অনন্ত তা আমি বলতে পারি না। এটি যেন সমুদ্রের জলের মতো আমার চারপাশে বয়ে চলে ... আমাকে স্মরণ রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। স্মরণ -ভারি শক্তিশালী শব্দ ।''
পরের বসন্তের চিঠি কোন চেরি ফলের খবর আনে নি, সেই বসন্তে এসেছিল ঘূর্ণায়মান দুঃখ। বন্ধুর মৃত্যু - সংবাদ। জানতেন এমিলি এই বেদনা কিভাবে জায়গা করে নেবে কবিতায়, আসবে স্মৃতি বেয়ে:
''Each that we lose takes part of us;
A crescent still abides,
Which like the moon, some turbid night,
Is summoned by the tides.''
আমরা যা হারিয়েছি সেগুলির প্রতিটিই আমাদের অংশ; একটা আধখানা চাঁদ, একটা ছায়া - মাখা মেঘ - মাখা রাত্রি, জোয়ারের আসা-যাওয়া সবই লেগে থাকে।
আমরা যখন প্রত্যেকেই প্রথমবার প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলি তখন যে শোকটি আমাদের গ্রাস করে তার নাম বিস্ময়। সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমরা কমবেশি সকলেই গিয়েছি। আমরা অনুভব করতে থাকি তার কবি চেতনাকে। বলতে গেলে প্রিয়জন হারানোর দুঃখের -যন্ত্রণার সম্পর্কে বিস্ময়ের প্রতিচ্ছবি যোগ করেন তিনি::
''প্রথম বন্ধু মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা একধরণের নিখুঁত নৈর্ব্যক্তিক সুড়ঙ্গের মধ্যে নিজেদের বসিয়ে রাখি, কোনোরকম শোকচ্ছাস দেখাই না, তবে তারপরেই আবিষ্কার করি যে সে নিজেই যেন একটা কাপ ছিল যেখান থেকে আমরা চা খেয়েছিলাম- এখন একদম অচেনা-অজানা হয়ে গেছে। ''
মৃত্যুর নিঃস্তব্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে , এক অসীম মহা শূন্য , প্রখর নীরবতার চিরন্তন প্রতিচ্ছবি এসে দাঁড়িয়েছে। জীবন যুদ্ধ, জয়-পরাজয় অর্থহীন এখানে , শুধু আছে জীবন ভাবনা আর বিস্তৃত ছড়িয়ে আছে গভীর আলো কিংবা অন্ধকার। সাথে যুক্ত হয়েছে এক প্রাজ্ঞ সময়কাল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন