সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আমি হয়তো আবার পাগল হয়ে যাবো- ভার্জিনিয়া উলফের আত্মহত্যা-একটি ট্রাজেডি: The Tragic Tale Of Virginia Wolf's Suicide

 সব আত্মহত্যাই কি আসলে একটা পরিকল্পিত খুন, নাকি স্ব-ইচ্ছায় পালিয়ে যাওয়া? না ফুরোনো স্বপ্ন নিয়ে চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে, কিন্তু ভার্জিনিয়া উলফা কেন আত্মহত্যা করে বসলেন? কোন আলো মাখানো জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলেন তিনি !  


 বসন্তের একটা দিন, হালকা শীত যেন লুকোচুরি খেলছে, যাই-যাই শীত আর গরমে কাবু হবার দিনগুলির মাঝে হালকা বাতাসের শিরশিরানি অনুভব করা যায়।  সকাল বেলার রোদ্দুর ছুঁয়ে যাচ্ছে চতুর্দিক। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত,  ছেলে বুড়ো সবাই বেরিয়েছে প্রাতঃভ্রমনে, কেউ বা ব্যস্ত সংসারের খুঁটিনাটি দেখভালে, আবার কারো রয়েছে কাজে যাবার তারা। কিন্তু একজনের কাছে যেন এই পুরো পৃথিবীর আর কিছুই ভালো লাগছে না, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে তার, লেখা হয়ে গেছে একটা নোট। ওসে নদীর দিকে ধীর পায়ে হাঁটছেন তিনি, কোটের পকেটে ভর্তি করেছেন প্রচুর পাথর, এই পথটা বোধহয় একাই  চলতে হয়, না, কেউ নেই সঙ্গে, কেউ নয়। এই পথ দিয়ে শুধু গন্তব্যে চলেছেন তিনি, যে গন্তব্য থেকে আর ফেরা হবে না, কোনোদিনও নয়, কখনও নয়, কারো কাছেই নয়, মনস্থির করে ফেলেছেন তিনি। কেন করলেন তিনি এটা, কেন নিতে হল এমন সিদ্ধান্ত!


আমি হয়তো আবার পাগল হয়ে যাবো- ভার্জিনিয়া উলফের আত্মহত্যা-একটি ট্রাজেডি: The Tragic Tale Of Virginia Wolfs Suicide
ভার্জিনিয়া উলফ ; Image Courtesy : wikipedia.org  


ইংরেজি সাহিত্যের প্রথিতযশা সাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উলফ, তার  অসামান্য লেখনীশক্তি মুগ্ধ করেছে লক্ষ লক্ষ মননশীল পাঠককে।  ''মিসেস ডলওয়ে'' বিখ্যাত উপন্যাস তার, ''এ রুম ফর ওয়ান'স ওন'' অসাধারণ প্রবন্ধ। মননশীল,মনমুগ্ধকর,চিত্তাকর্ষক- এই সবই উলফ এর লেখার জন্য কম পরে যায়। আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার সুচারু ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনী প্রাসঙ্গিকতার বার্তাবহনকারী। কিন্তু কি এমন হয়েছিল এই অসামান্য লেখিকার জীবনে যে একেবারে জীবন শেষ করে দেওয়ার  সিদ্ধান্ত নিতে হল ! ১৯৪১ সালের শরৎকাল, বাতাসে হালকা শীতের আমেজ, শীত যাই যাই করছে, ভার্জিনিয়ার  মনে ভিড় করেছে কত কথা, বিষণ্ণতার ঢেউ উঠেছে, কেউ রাখেনি তার মনের খবর, পাথর পকেটে ভ'রে  তাই চলে গেলেন নদীর ধারে , যে নদীর ধার ঘেঁষে চলে যাওয়া যায় এক না-ফেরার দেশে- সেখানে নাকি কোনো মন খারাপই আর ছুঁতে পারে না কাউকে!

সব আত্মহত্যা কি আসলে পরোক্ষে একটা খুনের ইঙ্গিত দেয় না! ভার্জিনিয়া ছিলেন দুর্ভাগ্যের শিকার, ভাগ্যের চরম দুর্ভোগের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে তাকে, জীবনের অধিকাংশ সময় জুড়েই তাকে ঘিরে থেকেছে মানসিক অসুস্থতা।

ভার্জিনিয়া  উলফের জন্ম ২৫সে জানুয়ারি, ১৮৮২ সালে ইংল্যান্ডে , আসল নাম নী এডেলিনে ভার্জিনিয়া স্টিফেন, এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা স্যার লেসলি স্টিফেন আর মা জুলিয়া  স্টিফেন দুজনেই ছিলেন  লন্ডনের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ত্ব। দুজনেই ছিলেন লেখক। লেসলি ছিলেন ডিকশনারি অফ ন্যাশনাল বায়োগ্রাফির  সম্পাদক। জুলিয়া তার নার্সিং পেশা সংক্রান্ত বই লিখেছেন।  ভার্জিনিয়া আর তার বোন ভেনেসার প্রথম শিক্ষা তাদের বাড়িতেই, তাদের বাবার বিশাল লাইব্রেরি ছিল তাদের প্রথম স্কুল।  তারপরে তারা দুজনেই লন্ডনের কিংস কলেজে ভর্তি হন।  

স্নাতকস্তরের পাঠশেষ করবার পর ভার্জিনিয়া সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন । ব্লুমসবার্গ গ্রূপ জনপ্রিয় ছিল তার শিল্পী,বুদ্ধিজীবী আর সাহিত্যিকদের জন্য। ভার্জিনিয়া সেই গ্রূপে যোগদান করেন।
এখানেই তার সঙ্গে প্রবন্ধকার লিওনার্ড উলফ এর আলাপ, পরবর্তীতে যিনি তার জীবনসঙ্গী হবেন। ১৯১২ সালে বিয়ে করেন তারা, তার পরবর্তীকালে একটা প্রিন্টিং প্রেস কেনেন- হোগার্থ প্রেস,আর সেই প্রেস থেকেই প্রকাশিত হতে থাকে সিগমুন্ড ফ্রয়েড আর টি.এস এলিয়ট এর সমস্ত লেখা। ভার্জিনিয়ার লেখাও এইসময় প্রকাশিত হতে থাকে, তার প্রথম উপন্যাস  প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে, '' দ্য ভয়েজ আউট'', কিন্তু তখনও ভার্জিনিয়ার সাহিত্যসৃষ্টি জনপ্রিয়তার নিরিখে পিছিয়েই ছিল, কিন্তু ১৯২৫ সালে প্রকাশিত চতুর্থ নভেল ''মিসেস ডলওয়ে'', প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা, নারীবাদ,মানসিক সমস্যা এবং সমকামিতা। 


Virginia And Leonard Woolf
সুখী দম্পতি - ভার্জিনিয়া  উলফ এবং লিওনার্ড উলফ ; Image Courtesy : newsweek. com 



ভার্জিনিয়া আরো বেশি করে নিজের লেখা প্রকাশ করতে থাকেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যন্য সাধারণ উপন্যাস সেগুলি, এবং আস্তে আস্তে তা জনপ্রিয়তাও  লাভ করতে থাকে। ''টু দি লাইটহাউস'' এবং ''অরল্যান্ডো''  এর মধ্যে অন্যতম। নারীশক্তির উত্থান নিয়ে লেখা, যদিও সেই প্রবন্ধ অনেক বেশি খ্যাত নারীবাদী লেখা হিসেবে- '' এ রুমস অফ ওয়ান'স ওন'' এবং ''থ্রী গিনিস'' উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত লেখাই সাহিত্য-সমালোচকদের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল, ভার্জিনিয়াকে দিয়েছিল এক বিশিষ্ট সাহিত্যিকের আসন। ছক ভাঙা চিন্তাভাবনা এবং গভীরতর লেখনশৈলীই  ভার্জিনিয়াকে সবার থেকে করেছিল আলাদা, দিয়েছিল বিশিষ্টতার আসন

কিন্তু, এখানে একটা কিন্তু থেকে যায়, এত যার চোখধাঁধানো সাফল্য, তিনি বহুবার নিজের জীবন শেষ করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। ভার্জিনিয়ার এই সাফল্যের স্বাদও তাকে ভালো রাখতে পারেনি, আদপেও ভালো ছিলেন না তিনি। কিন্তু কোনো এমন চিন্তা মনের মাঝে, কেন নিজের জীবনটাকে এইভাবে শেষ করে দিতে চাইলেন তিনি? কেন, কেন আর কেন? ভার্জিনিয়া একবার বলেছিলেন- পুরো ছোটবেলাটাই হয়তো আমাদের একটা কল্পনার মধ্যে দিয়ে কেটে যায়, আমরা একটা বিভ্রান্তির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে যাই। যত বড় হতে থাকি এই বিভ্রান্তিটা কেটে যেতে থাকে। আমরা একটা অন্য মানুষ হয়ে যাই। 

ভার্জিনিয়াও বাস করতেন নিজের জগতে, সবকিছুই যেন অন্যরকমের সুন্দর ছিল এই দুনিয়ার। কিন্তু ধাক্কা খেয়েছিলো এই স্বপ্নময় জগৎ, এই কল্পনার জগৎ। ঘোর কেটে গিয়েছিলো তার। প্রবল মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন তিনি, হয়েছিলেন ক্ষতবিক্ষত
কিশোরীবেলার এই আঘাত ট্রমার পর্যায় চলে গিয়েছিল। যে পাশবিক, যে নারকীয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি বাঁচবার যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন - তার নিজের পরিবারের লোকজনই দায়ী ছিল তার জন্য, জর্জ আর জেরাল্ড ডাকওয়ার্থ, ভার্জিনিয়ার সৎ দু ভাই নিয়মিত শারীরিক ভাবে নিগ্রহ চালাত তার উপর। নিজের অনেক ব্যক্তিগত প্রবন্ধে এই যৌন-উৎপীড়নের কথা লিখে গেছেন তিনি, এটা শুরু হয়েছিল ভার্জিনিয়ার ৬ বছর বয়েসে ! কি নারকীয় অত্যাচার চলেছে ছোট্ট ভার্জিনিয়ার উপর! আর এই অত্যাচারের পরিসমাপ্তি ঘটে ২৩ বছর বয়েসে, যখন ভার্জিনিয়া তার পরিবার  থেকে দূরে থাকতে শুরু করেন। এই অত্যাচারের আতঙ্ক কোনোদিন মুছে যায়নি তার মন থেকে, নারকীয় সেই ঘটনা, ভয়ানক সেই দমবন্ধকর দিনগুলো, কাউকে বলতে না পারা, ডুকরে নিজের ভিতরে কঁদতে থাকা দিনগুলো, কোনোদিন সুস্থভাবে বাঁচতে দেয়নি ভার্জিনিয়াকে। 

চরমতম মানসিক অবসাদের শিকার হন তিনি, ১৮৯৫ সালে মা কে হারান ভার্জিনিয়া। একা হয়ে যান, দুঃসহ এক নিঃসঙ্গতায় ডুবে যান তিনি। ১৩ বছর বয়েসে, প্রথমবার দেখা দেয় স্নায়ুবৈকল্য। মায়ের মৃত্যুতে যেন সব কিছু হারিয়ে ফেললেন ভার্জিনিয়া, মা কে হারানোর পরপরই ট্রমার শিকার হন। আর সেটা চলতে হতে থাকে বছরের পর বছর, সৎ বোন স্টেলা মারা যায় মায়ের মৃত্যুর দু বছর পরেই, আর ১৯০৪ সালে চলে যায় ভার্জিনিয়ার বাবা, যকৃৎ এর  ক্যান্সারে।   এত মৃত্যু ! এত চলে যাওয়া বোধহয় আর সহ্য করা যায় না। ফল হল সাংঘাতিক, মানসিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসাধীনও থাকতে হল তাকে, কিন্তু তা বেশি দিনের জন্য নয় ।  

সুখ আর শান্তি ফিরে এসেছিল জীবনে, যা হারিয়ে গেছিল তার জীবন থেকে ফিরে এসেছিলো তারা, লেখার মধ্যে দিয়ে সাফল্য ধরা দিতে শুরু করে। আর লিওনার্ড এর সঙ্গে সুখী বিবাহিত জীবন। একদম নিস্তরঙ্গ, শান্ত, গভীর ছিল তাদের ভালোবাসা। কিন্তু হানা দিয়ে যায় অতীতের স্মৃতি। ভার্জিনিয়ার জীবনের অঙ্গ হয়ে রইল অবসাদ আর মানসিক অসুস্থতা। অনেকবারই নিজের জীবন নেবার চেষ্টা করেছে ভার্জিনিয়া, এক ধরণের হালুসিনেশন এ ভুগতেন তিনি, এছাড়াও তাকে ঘিরে ধরেছিলো বিভিন্ন ম্যানিয়া।, 

 প্রচুর রকমের মানসিক চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে যান ভার্জিনিয়া, বলতে গেলে চিকিৎসার নামে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছিল তার উপর, কিন্তু সেইসময় মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতির তেমন উন্নতি হয়নি, মানসিক চিকৎিসার গবেষণা তখন অংকুরের পর্যায়। তাই সেভাবে চিকিৎসায় কোনো নিশ্চিন্ত ফল পাওয়া যায় নি, কোনো সঠিক  দিক নির্দেশ করতে পারে নি।  ফলাফল শুধুই ভুল হতে থাকে। ১৯২০ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটা অদ্ভুত এবং ভ্রান্ত ধারণা ছিল- মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে নাকি দাঁতের সমস্যার যোগ আছে, দাঁতে কোনো সংক্রমণ  হলে নাকি তা মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্ন ঘটার কারণ হয়।  তাই এই চিকিৎসায় ভার্জিনিয়ার অনেকগুলি দাঁত  তুলতে হয়। 

ভার্জিনিয়ার সুইসাইড নোট এবং শেষের সেই দিন :

২৮সে মার্চের সকাল, সাল ১৯৪১, লিওনার্ড বুঝতে পারছিলেন কিছু যেন ঠিক নেই, ২৯ বছরের বিবাহিত জীবন, অনেক কিছুই আঁচ করতে পারছিলেন তিনি। একমনে কিছু বসে লিখছিলেন ভার্জিনিয়া,কথা হলো কিছুক্ষণ, তারপর উঠে  পড়লেন তিনি, বাড়ির ভিতরে একবার যেতে চান । সেটা অবশ্য লিওনার্ড ই পরামর্শ দিলেন, একটু বিশ্রাম করতে।  এই শেষ দেখা তার সঙ্গে ভার্জিনিয়ার।

এরপর লিওনার্ড  নিজের অফিসে ফিরে  গিয়েছিলেন। ঘরে ফিরে এসে নিজেকে অনেকটা সময় দিলেন ভার্জিনিয়া, নিজের সঙ্গে যেন যুদ্ধ করছিলেন তিনি। নিজের ফার কোটটাকে শরীরে জড়িরে নিলেন, পা গলালেন ওয়েলিংটন বুটে, সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলেন, এবারে তার গন্তব্য  বাড়ির কাছে ওসে নদী। দু ঘন্টা পরে যখন লিওনার্ড ভর্জিনিয়াকে খুঁজতে উপরে গেলেন তখন দেখলেন দুটো নোট - সুইসাইড নোট। ভির্জিনিয়া ঘরে নেই,  একটা সুইসাইড নোট লিওনার্ড কে উদ্দেশ্য করে লেখা আর একটা বোন ভেনেসাকে।


Portrait Taken Before Virginia Woolf's Death
মৃত্যুর আগে তোলা ভির্জিনিয়া উলফের শেষ ছবি ; Image Courtesy : wikimedia commons



ভার্জিনিয়া উলফের সুইসাইড নোট  যেটি লেখা হয়েছিল লিওনার্ডকে উদ্দেশ্য করে:



প্রিয়তম, 

''আমার কেন  জানি না মনে হচ্ছে আমার মাথা বোধহয় আবারও  খারাপ হতে চলেছে, আমি হয়তো আবার পাগল হয়ে যাবো, যে ভয়ঙ্কর দিনগুলির সাক্ষী থেকেছি আমরা, সেই সময়ের মধ্যে দিয়ে আর যেতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না, সে শক্তি আর আমার নেই।  আর এবার বোধহয় আর আমি সেরে উঠবো না। কিরকম যেন সব আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি- চারিদিকে করা যেন ফিসফিস করছে। আমি কোথাও মনোযোগ দিতে পারছি না।  তাই আমি যা করতে যাচ্ছি সেটাই আমার জন্যে ভালো।''

স্পষ্ট, ভার্জিনিয়া হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন, নিজের অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ডুবে যাচ্ছিলেন তিনি। এক অন্ধকার ঘেরাটোপের ভিতরে ঘুর্ণিপাকের দুর্বিপাকে যেন আটকে পড়েছিলেন তিনি। আর সেখান থেকে কেউ তাকে বের করে আনতে পারে নি। 

ভার্জিনিয়া আরো লিখছেন, ''আমার এই জীবন সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার জন্য তোমার কাছে আমি  ঋণী। আমার  এই জীবনকে খুশিতে ভড়িয়ে তুলেছ  তুমি, আমার ব্যাপারে চিরটাকালই তুমি খুব ধৈর্য দেখিয়েছো, সুন্দর করে তুলেছো আমার জীবন। শুধু আমি বলছি বলেই নয় সবাই জানে এটা।  আমাকে যদি কেউ রক্ষা করে থাকে তাহলে সেটা তুমি। আমার জীবনে কিছুই ছিল না তোমার  অনন্ত ভালোবাসা আর বিশ্বাস ছাড়া, আমরা দুজনে অপার সুখী ছিলাম, আমার মনে হয় না আমাদের থেকে বেশি কেউ সুখী হতে পেরেছে।”


Virginia Woolf's Suicide Note
ভার্জিনিয়া উলফের সুইসাইড নোট ; Image Courtesy : allthatsinteresting.com 




হতভম্ব লিওনার্ড, হাতের চিঠি হাতেই ধরা রইলো। তারপরের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকলো অতি  দ্রুত, খুঁজতে যাওয়া হল আশেপাশের সমস্ত এলাকাগুলিতে, পায়ের ছাপ দেখা গেলো নদীর পারের নরম হয়ে যাওয়া মাটিতে, আর হাতের ছড়িটাও  খুঁজে পাওয়া গেলো ঠিক  সেখানই। কিন্তু ভার্জিনিয়ার কোনো চিন্হ দেখতে পাওয়া গেলো না। হয়তো স্রোতের টানে ভেসে চলে গেছে।অবশেষে পাওয়া গেলো ভার্জিনিয়াকে, তিনসপ্তাহ পরে আবিষ্কৃত হলো- ইংল্যান্ডের সাউথএসে । ভার্জিনিয়ার আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লো। ভার্জিনিয়ার মৃত্যুসংবাদ শুনে টি.এস এলিয়ট লিখেছিলেন-'' পৃথিবীটা শেষ হয়ে গেলো।''

মৃত্যু পরবর্তী অধ্যায় :

ভার্জিনিয়াকে সমাধিস্থ করা হয়, আর সমাধির কিছুটা মাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় দুটো এলম গাছের নিচে। গাছদুটির একটির নাম ছিল ''ভার্জিনিয়া'' আর একটি গাছের নাম ''লিওনার্ড''। আর এই গাছদুটি ছিল ভার্জিনিয়া আর লিওনার্ড এর বাড়ির ঠিক পিছনেই। ভার্জিনিয়ার শেষ উপন্যাস ছিল- ''দ্য ওয়েভস''- সেই উপন্যাসেরই শেষের কিছু লাইন খোদাই করে দিয়েছিলেন লিওনার্ড পাথরে, '' হে মৃত্যু! তুমি অপরাজেয় এবং অনমনীয়, তোমার বিরুদ্ধে যাওয়া অনর্থক।কারণ, তীরে এসে সব ঢেউকেই ভাঙতে হয়। '' সব ছেড়ে চলে গেছিলেন ভার্জিনিয়া, ছেড়ে গেছিলেন তার লিওনার্ড এর সঙ্গে তার ভালোবাসার সংসার, তার লেখাগুলি, পিছনে ফেলে গেছিলেন তার অসম্পূর্ন আত্মজীবনী, একটি অসমাপ্ত উপন্যাস। ভাগ্যের কি পরিহাস, ভার্জিনিয়া উলফের শেষ রচনা তার নিজের সুইসাইড নোট! 


উলফের নাম,  তার সমস্ত সাহিত্য সৃষ্টি আমার হয়ে রয়েছে পাঠকের মননে, তাদের চিন্তায়, তাদের চেতনায়। তার উপন্যাস ক্ল্যাসিক সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত, তার লেখা প্রবন্ধগুলিকে আধুনিক নারীবাদের প্রতীক বা আইকন হিসেবে পরিগনিত। শুধু সাহিত্যে নয়, চলচ্চিত্রেও আমার হয়ে আছেন ভার্জিনিয়া; মাইকেল কাননিংহাম এর পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী উপন্যাস ''দ্য আওয়ার'' এর চিত্ররূপ যেখানে অসামান্য অভিনয় করেছেন নিকলে কিডম্যান- ভার্জিনিয়ারই গল্প বলে।  

ভার্জিনিয়া উলফের মৃত্যু আবার অন্য্ একটা দিক খুলে দিয়েছে।একদল  গবেষক একধরণের app তৈরি করবার চেষ্টা করছেন যেখানে কোনো মানুষের  আত্মহত্যার প্রবণতা আছে কিনা তার হাতের লেখা দেখে ভবিষ্যৎবাণী করা যাবে। ভার্জিনিয়ার ডায়েরি ঘেঁটে- এই ডায়েরি ভার্জিনিয়া সারাজীবন নিজের সঙ্গে রেখেছিলেন, তার ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের সংগ্রহ ঘেঁটে গবেষকরা একটা সফটওয়্যার তৈরি করার চেষ্টা করছেন যার মাধ্যমে কোনো মানুষের টেক্সট ম্যাসেজ, ই-মেইল, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট থেকে তার  কোনো রকম আত্মহত্যার ঝুঁকি আছে সেটা বিশ্লেষণ করা যাবে। যদি এই সফটওয়্যার কোনো রকম নেগেটিভ পরিবর্তন সনাক্ত করতে সমর্থ হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে একটা স্বয়ংক্রিয় সতর্কবার্তা চলে যাবে সেই মানুষটির পরিবার, পরিজন, বন্ধুবান্ধবের কাছে। সাহায্য করাও যাবে খুব তাড়াতাড়ি। 

খুব অদ্ভুত লাগছে যদিও কথাটা শুনতে, ভার্জিনিয়া উলফের আত্মহত্যা পরবর্তী কালের বিজ্ঞান গবেষণা বলা ভালো টেকনোলজির গবেষণার একটি দিক উন্মোচন করে দিয়ে গেছে।আর এই গবেষণার পথ তার বিষন্ন  জীবন কিংবা মৃত্যুর অতলান্ত গভীরতা থেকে ব্যাপ্ত। 

শেষ করবো ভির্জিনিয়া উলফের লেখা লাইন দিয়ে- '' যদি আকাশের তারা কিংবা নক্ষত্রের মতো বিষয়কে  ভাবনা করি তাহলে আমাদের মতো মানুষজনের রোজকার সমস্যাগুলিকে ছোটই মনে হয় না কি?'' 




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস বা মগ্নচৈতন্য / What is Stream of Consciousness?

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস ? সাহিত্য ধারায় এটি এক রীতি, বলতে গেলে লেখনীর এক ধরণ। সাহিত্যের আলোচনায়  কিংবা সমালোচনায় 'স্ট্রিম অফ কনসাসনেস'- ‘Stream of Consciousness’  বা মগ্নচৈতন্য শুধুমাত্র এক শব্দ নয়, এ এক অনন্য, এক স্বতন্ত্র জঁর  ।  মগ্নচৈতন্যের   স্রোত সাহিত্যসৃষ্টির এক অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন ধারা,  যা কিনা  বিংশ শতাব্দীর কিছু বিখ্যাত লেখক   নিযুক্ত এক স্বতন্ত্র লেখন রীতি। নিজেদের লেখনীতে কিছু ঘটনা পরম্পরাকে  বর্ণনা করতে ব্যবহার করেছিলেন তারা ।  কিন্তু '  মগ্নচৈতন্য '  কী?  কেনই বা  এটি একটি 'ধারা' বা ' জঁর' ?  কিছু  পরিচিতি দিলাম বটে শুরুতে কয়েকটি শব্দকে আশ্রয় করে, তবে  বিস্তারিত আলোচনা  এগোবে আস্তে আস্তে।  এই আপাত সাধারণ এবং একইসঙ্গে ব্যাপকভাবে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা যুক্ত , সাহিত্যিক টার্মটির ধারণা  পরিষ্কার করতে সহায়তা করতে পারে হয়ত এই  আলোচনা ।   Image Courtesy: Steve Jhonson:pixels.com/free image প্রকৃতপক্ষে...

একটি প্রেমের গল্প : অমৃতা প্রীতম এবং সাহির লুধিয়ানভি / The love story of Amrita Pritam and Sahir Ludhianvi

প্রেমের গল্প। প্রেম ভাঙার গল্প। পাত্র-পাত্রী সাহির লুধিয়ানভি এবং অমৃতা প্রীতম। দিকপাল দুই সাহিত্যিক। কেমন ছিল সেই সম্পর্ক ? ''আমি তো জানতাম সাহির, তোমার কোনোদিনই আমার প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো দায় ছিল না । কি যেন বলে আজকাল ! ও হ্যাঁ , কমিটমেন্ট ফোবিয়া।  ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবে কি না সেই দ্বিধাতেই তো রয়ে গেলে। কেন  যেন মনে হয় আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা  সেই গভীরতর  অতলান্ত  স্পর্শ করে নি কোনোদিন। ছুঁয়ে দেখেনি সেই ভালোবাসার তীব্র টানকে। আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবেসেছ  ? যতটা আমি তোমাকে বেসেছি।  "ম্যায়নে টুট  কে প্যায়ার কিয়া তুম সে / ক্যায়া  তুমনে ভী উতনা কিয়া মুঝ সে?'' অমৃতা প্রীতম এবং সাহির লুধিয়ানভি : Image Courtesy : Indian Express  ' ''মোহাব্বত কি পরখ  কা  ইয়েহি  তো রাস্তা  হ্যায় / তেরি  তালাশ মে নিকলু, তুঝে  না  পায়ু  ম্যায় '' । অমৃতা ভালোবাসা খুঁজেছেন, সেই আকুল করা ভালোবাসা,  হৃদয় তন্ত্রীতে সেই তীব্র...

ভারতে পিকনিকের খাবারের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস / The Diverse History Of Picnic Food In India

  ভারতে পিকনিকের খাবারের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস / The Diverse History Of Picnic Food In India ভারতে  কিরকম ভাবে হয় পিকনিক। কিভাবেই বা হতো ব্রিটিশ আমলের পিকনিক? মহাভারতের যুগেও কি হতো পিকনিক?  পিকনিক: Image Courtesy: Getty Image  মহাভারত থেকে ব্রিটিশ রাজ - বাড়ির বাইরে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া , না, না কোনো রেস্তোরাঁর কথা বলছি না, বলছি পিকনিকের (picnic) কথা,  বাংলায় চড়ুইভাতি বলি যাকে। ছোটবেলার পিকনিকের স্মৃতি রাজত্ব করছে এখনও,আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু যুগের ঐতিহ্য এই চড়ুইভাতি এখনও টিকে আছে বহু বদলের পরেও।  শুধুমাত্র মেনু পরিবর্তিত হয়েছে,পরিবর্তিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর চরিত্র, ভৌগলিক দূরত্বের সাথে আলাদা হয়েছে বিভিন্ন  চড়ুইভাতির রকম - সকম, খাবারের মেনুর। আশি কিংবা নব্বই দশকের প্রকাশিত হওয়া কোনো গল্পের সিরিজে, সিরিয়ালে, উপন্যাসে, কিংবা রম রম করে  হল গুলোতে চলা সিনেমাতে  পক্ষে মেয়েদের রঙিন মাসিক পত্রিকাতে  পিকনিকের উল্লেখ , ছবি থাকতই থাকত। বড় বেলায় দেখে ছোটবেলার পিকনিকের ছবি। কিন্তু  একটা জিনিস নিয়ে দুঃখ আমার বরাবরই থেকে...