‘সাহিত্যের অগ্রগতি আসলে একটি জাতির আরোহণ’ - মুন্সী প্রেমচাঁদ/ ‘The ascent of literature is the ascent of a nation’- Munsi Premchand
হিন্দি সাহিত্যে মুন্সী প্রেমচাঁদ এক অবিস্মরণীয় নাম। সাহিত্য রূপ বিশ্লেষণে কি ভেবেছেন তিনি ? কিভাবেই বা তিনি দেখতেন সাহিত্যকে ?
জীবনই হ'ল সেই ভিত্তি যার উপরে সাহিত্য নির্মিত হয়, সাহিত্যের প্রতিটি রূপ স্থাপিত হয়। একটি বিল্ডিংয়ের মিনার, গম্বুজ এবং হলঘরগুলি দৃশ্যমান হয় কিন্তু এর ভিত্তিভূমি অদৃশ্য রয়ে যায়। জীবন ঈশ্বরের সৃষ্ট, এবং তা সীমাহীন এবং অনিবার্য, তা অনির্বচনীয়। সাহিত্য মানবের দ্বারা সৃষ্ট, তাই তা বোঝা এবং উপলব্ধি করা সহজ। ঈশ্বরের কাছে জীবন দায়বদ্ধ কিনা তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না, তবে সাহিত্য অবশ্যই মানুষের কাছে জবাবদিহি দাবি করে। সাহিত্যের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে যা আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না।
একজন মানুষ জীবনের গোলকধাঁধায় আনন্দের সন্ধানে নিজেকে নিমজ্জিত করে। কিছু মানুষ ধনরত্নের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেবার চেষ্টা করে, কেউ সুখী পরিবারে, কেউ বড় বড় অট্টালিকায়, কেউ বা বিলাসিতায় আনন্দ খুঁজতে থাকে অবিরাম। ভাল সাহিত্য পড়ার আনন্দ এই আনন্দগুলির চেয়ে বৃহত্তর এবং এই আনন্দগুলির অপেক্ষা অনেক বেশি শুদ্ধ, কারণ এর ভিত্তি সৌন্দর্য এবং সত্যে নিহিত। প্রকৃতপক্ষে সত্য আনন্দই সত্য এবং সৌন্দর্যে নিহিত;আর সেই অভূতপূর্ব আনন্দের এক ঝলক আমাদের মধ্যে চারিত করে দেওয়াই সাহিত্যের আসল লক্ষ্য।
প্রায়শই আমাদের মধ্যে এক অপরাধবোধ জাগ্রত হয় বস্তুগত সামগ্রীর নিরবচ্ছিন্ন সেবনের ফলে।অনেকে জাগতিক বস্তুগত সামগ্রী অপছন্দ করা শুরু করতে পারে, নিজেকে দোষী মনে করতে পারে;তবে সৌন্দর্য্য থেকে প্রাপ্ত আনন্দ বা সুখ অবিভাজ্য এবং অনন্ত, অনিঃশেষ, অফুরন্ত।
সাহিত্যে নয়টি রস রয়েছে। সদর্থক বা উন্নত সাহিত্য যদি আনন্দের দিকে পরিচালিত করে, তবে প্রশ্ন উঠছে বীভৎস রসেও কি সৌন্দর্য বর্তমান? যদি তা না হয় তবে কেন তাকে রসগুলির মধ্যে গণনা করা হয়? প্রকৃতপক্ষে, সৌন্দর্য্য এবং সত্য এই দুইয়েরই উপস্থিতি রয়েছে বীভৎস রসে। যেভাবে শ্মশান বা কবরস্থানকে চিত্রিত করা হয়েছে - তা কতটা ভয়াবহ হতে পারে? তা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইপ্রকারে, পিশাচ এবং শয়তানেরা অর্ধ-দগ্ধ মাংস ভক্ষনরত! তারা নিজেদের মধ্যে মানুষের মাংসের উপকারিতার কথা আলোচনা করতে করতে একনাগাড়ে হাড় চিবিয়ে চলেছে - কি ঘৃণ্য এই দৃশ্য! তবুও এই চিত্রটি সৌন্দর্যের দিকে পরিচালিত করে!কারণ এই অনুভূতি এক অনন্ত সৌন্দর্য্যের দিকে করে, পরম উচ্চতর সুখের সন্ধান দেয়, যা ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়।
সাহিত্যে রস এবং প্রতিটি সংজ্ঞা-অবস্থানেই সৌন্দর্য্যে খুঁজে নিতে হয়: রাজার আলোকজ্জ্বল প্রাসাদে, নিঃসম্বলের কুঁড়েঘরে, পয়ঃপ্রণালীর মধ্যে, আরক্ত ভোরে এবংবর্ষণমুখর রাতে।কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাজবাড়ীর তুলনায় সৌন্দর্য্যের ঝলক দেখা যায় সম্বলহীনের কুটিরে! খুব বেশি ঝলমলে হয় তা সৌন্দর্য্যের আলোতে।
সত্যের সাথে আত্মার তিনটি সম্পর্ক রয়েছে। প্রথমটি হ'ল কৌতূহল, দ্বিতীয়টি উদ্দেশ্য এবং তৃতীয়টি আনন্দের।
কৌতূহল হ'ল দর্শনের বিষয়, এবং উদ্দেশ্য বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত; কেবল আনন্দই সাহিত্যের বিষয়। সত্য যখন আনন্দের উৎস হয়ে যায়, তখন তা হয়ে ওঠে সাহিত্যেরই অংশ।কৌতূহল চিন্তার দ্বারা অনুপ্রাণিত, এবং উদ্দেশ্য স্বার্থ এবং বুদ্ধি দ্বারা। আনন্দ আবেগের সাথে সম্পর্কিত, এবং সাহিত্য শুধুমাত্র আবেগ থেকে উদ্ভূত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, তুষারাবৃত পাহাড়ের উপর ভোরের যে অপূর্ব চিত্র আমরা দেখি সেই দৃশ্যে আমরা তিনটি ভিন্ন উপায়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি। এই জাতীয় দৃশ্য দেখে একজন দার্শনিক গভীর চিন্তায় ডুবে যাবেন ।একজন বিজ্ঞানী গভীর অনুসন্ধানে প্রবৃত হ'ন। একজন সাহিত্যিক অবশ্য পরিতোষী ব্যক্তি হন। পরমানন্দ হ'ল আত্মসমর্পণের মতো। এখানে কেউ বিচ্ছেদ অনুভব করে না।এখানে, উচ্চ এবং নিম্ন, ভাল এবং খারাপের মধ্যে বৈপরীত্য বা দ্বন্দ্বগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়, অস্পষ্ট হতে থাকে তা। আত্মা পুরো বিশ্বের কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করে।বিস্তৃত এই বিশ্ব।একজন ব্যক্তির আত্মা যত বেশি বিস্তৃত হয় তা ততবেশি দুর্মূল্য হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ তার সর্বাপেক্ষা নিজের যে গুনকে বিকশিত করতে পারে, তা হ'ল, তার স্বত্ত্বাকে প্রাণহীন বিশ্বের সাথে মিশিয়ে দিতে পারে।
মানুষের জীবন অবশ্যই শুধুমাত্র বেঁচে থাকা, খাওয়া, ঘুমানো এবং তারপরে মারা যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সমস্ত জীবেরই এক উদ্দেশ্য থাকা উচিত। প্রকৃতি সাথে একাত্মতাই তার উদ্দেশ্য। প্রখর ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্য দেখা যায় কিছু মানুষের মধ্যে, আবার কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধতাও থাকে। অহংকার, ক্রোধ এবং ঘৃণা বিচ্ছিন্নতা স্থায়ী করে।আমরা যদি আমাদের জেদের বশে তাদের পরখ না করা অব্যাহত রাখি তবে তারা আগামীতে আমাদেরকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে। এজন্য আমাদের তাদের ব্যক্তি-চৈতন্যে লাগাম পরানো দরকার, তবে তা কীভাবে সম্ভব ?
অবাধ্য শিশুদের বকুনি দেওয়া বা তারা কোনও কিছুই করতে পারবে না এই জাতীয় কথা বলা কোনো কাজে আসে না আসলে, সময়ের অপচয় ছাড়া।অনেকে মনে করে, এ জাতীয় পদক্ষেপ তাদের আচরণকে পরিবর্তন করবে, উৎসাহিত করবে তাদের ইতিবাচক স্বভাবগুলিকে। কিন্তু আদতে যা প্রয়োজন তা হ'ল তাদের নেতিবাচক স্বভাবগুলিকে দূরীভূত করা। আমরা বাচ্চাদের কেবলমাত্র ভালোবাসা এবং স্নেহের দ্বারা প্রভাবিত করতে পারি, বকাঝকা করে নয়।একইভাবে, নেতিবাচক স্বভাব বা প্রবৃত্তিগুলি যদি মানুষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে, তবে সুশৃঙ্খলতার জন্য, আমাদের এমন সম্ভাবনাকে উদ্দীপিত করতে হবে যা সমগ্র প্রকৃতি সত্ত্বার সাথে মানুষের মিলন সাধিত করে।একা সাহিত্যই গভীর মানবিক আবেগতাড়িত সংবেদন উন্মুক্ত করতে সক্ষম। একত্রিত করে এই সু-প্রবৃত্তিগুলিকে,নতুন করে আবিষ্কার করে।
সাহিত্য শুধুমাত্র চিন্তার বিষয় নয়; এটি হৃদয়েরও বিষয়। যেখানে জ্ঞান ও উপদেশ ব্যর্থ হয় সেখানে সাহিত্য সফলতা লাভ করে।
আমরা এইভাবে উপনিষদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থগুলিকে সাহিত্যের সহায়তা প্রাপ্ত হতে দেখি।আমাদের আধ্যাত্মিক শিক্ষকরা দেখেছিলেন যে, মানুষের আনন্দ ও দুর্দশার বর্ণনা মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই তারা মানবজীবন নিয়ে এমন গল্প তৈরি করেছিলেন যা আমাদের জন্য আনন্দের উৎস হয়ে উঠেছিল।তাই, জাতক, তাওরাত, কুরআন, ইনজিলের গল্পগুলি কেবল মানুষের জীবন-পথের গল্পের সংগ্রহ মাত্র।
এই গল্পগুলি আমাদের ধর্মের প্রাণ। এই গল্পগুলি সরিয়ে নিলে, ধর্ম হোঁচট খাবে। ধর্মের প্রবক্তারা এই কারণেই এই গল্পগুলিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের বার্তা কেবলমাত্র হৃদয়ছোঁয়া গল্পের মাধ্যমেই মানুষের প্রাণের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হতে পারে। এই সাধকেরা ছিলেন মহান মানুষ, তারা তাদের নিজেদের সত্ত্বাকে সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন। এই সাধকেরা সাধারণ মানুষের সাথে নিজেদের জীবনের আর মতবাদের সঙ্গতি, সাদৃশ্য এবং সামঞ্জস্য রেখেছিলেন। কীভাবেই বা তারা মানব-চরিত্রের বিভিন্ন দিককে উপেক্ষা করতে পারেন!
প্রাচীন কাল থেকে, একজন মানুষের নিকটতম সঙ্গী কিংবা প্রতিবেশী ছিল অন্য্ একজন মানুষই। আমরা আমাদের আত্মাকে কেবলমাত্র তাদের সাথেই একীভূত করতে পারি যাদের আনন্দ এবং বেদনা, হাসি এবং অশ্রু আমরা অনুভব করতে পারি। একজন শিক্ষার্থীর তার ছাত্রজীবনের সাথে যে সম্পর্ক বা একজন কৃষকের কৃষিকাজের প্রতি যে সম্বন্ধ অথবা সখ্যতা রয়েছে তা নিশ্চয়ই অন্যের জীবনের বা কাজের জন্য তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করার পরে, এই বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায়। যেন আমাদের মানব-বোধ, আমাদের মানব জগৎ, বিশাল-বিরাট- এবং বিস্তৃত হয়ে পুরো বিশ্বের উপর দাবী ন্যস্ত করেছে । কেবল মানব জগতই নয়, গোটা বিশ্বজগতের প্রাণী এবং উদ্ভিদ জগতের উপরেও সার্বভৌমত্বের দাবি করেছে।
সাহিত্য হ'ল সেই যাদুবিদ্যার যাদু-ছড়ি যা সর্বজনীন আত্মার সমার্থক, সার্বিক অন্তরাত্মার এক ঝলক দেখি আমরা পৃথিবীর সব জায়গাতেই - প্রাণীদের মধ্যে, গাছেদের মধ্যে, এমনকি পাথর এবং ছোট ছোট জলাশয়ের মধ্যেও। আমরা প্রায়শই নিজের প্রতিচ্ছবি অন্য মানুষের মধ্যে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পরি, আমরা তাদের বেদনা এবং আনন্দকে উপলব্ধি করতে পারি, উপলব্ধি করতে পারি তাদের উল্লাস এবং হতাশাকে, প্রেরণা পাই তাদের সদর্থক জীবন-বোধ দ্বারা। একজন সত্যিকার লেখকের অনুভূতি বহু -বিস্তৃত হয়। তিনি প্রত্যেক পার্থিব সত্ত্বার সঙ্গে একীভূত, ঐক্যবদ্ধ সর্বজনীন অন্তরাত্মার সাথে, অর্জন করেছেন সঙ্গতি ও সাদৃশ্যপূর্ন ঐকতান; প্রত্যেক মানুষ অনুভূতিগুলি তার অভিব্যক্তিতে প্রতিবিম্বিত হয়।মানুষের সমগ্র হৃদয়ের জগৎ ইন্দ্রিয়লব্ধ হতে হবে এমন নয়।
একজন সৃজনশীল লেখক প্রায়শই তার সময় দ্বারা প্রভাবিত হন। সারা দেশের অস্থিরতার সময়, যখন এক অসহিষ্ণুতার বাতাস বইতে থাকে দেশ জুড়ে, তিনিও অবিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। তার অন্তরাত্মা দেশের মানুষের দুর্দশায় কাঁদে। মানুষের দুর্দশা খুব গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে।দুর্দশাগ্রস্ত,নিপীড়িত মানুষেরা এবং লেখক উভয়ই তাদের গোত্র বা জাতির অন্তর্গত, তাদের দেশাত্মবোধের আবেদনও সর্বজনীনও। আঙ্কেল টম'স কেবিন দাস প্রথার গল্প, দাসত্বের মতো এক চরম মর্মান্তিক প্রথার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। যদিও দাসপ্রথা কিংবা দাসত্ব বিলুপ্ত করা হয়েছে অনেক কাল আগেই, কিন্তু এই কাহিনীর আবেদন আজও একইরকম আছে।
সত্যিকারের সাহিত্য কখনই পুরোনো হয়ে যায় না। সময়ের সাথে সাথে দর্শন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ পরিবর্তিত হতে থাকে, তবে সাহিত্য হৃদয়ের বড় কাছের উপাদান এবং মানুষের হৃদয় পরিবর্তন হয় না।
আনন্দ এবং হতাশা, ক্রোধ এবং ঘৃণা, আশা এবং ভয়, আমাদের মধ্যে বর্তমান; জীবনের কাল থেকে কালান্তরে মানবহৃদয়ে তা একছত্র রাজত্ব করে চলেছে, সমস্ত মানব আবেগগুলো একছত্র অধিকার করে রয়েছে সময় থেকে সময়ান্তরে, এবং অনন্তকাল পর্যন্ত তা করবে। রামায়ণের সময় অতিবাহিত হয়েছে, না মহাভারতের সময়ও আর নেই। এখনো এই মহাকাব্যগুলি নতুনের মতো বোধ হয়। সাহিত্য আসলে একাই এক সত্য-ইতিহাস।
সাহিত্য যেভাবে সময় এবং স্থানকে জুড়ে দিতে পারে, তা ইতিহাস কোনো ভাবেই করতে পারে না। ইতিহাস শুধুমাত্র কিছু তারিখের সমাহার নয়, বা শুধুমাত্র রাজাদের যুদ্ধও নয়, ইতিহাস তার চেয়েও অনেক বেশি সত্য। প্রকৃত অর্থে ইতিহাস জীবনের খাঁজে খাঁজে থাকা বিচিত্র উপাদানগুলির অগ্রগতি। আর এখানে আসে সাহিত্যের ভূমিকা। সাহিত্যের চেয়ে আর কি কিছু সাধারণ মানুষের জীবনকে আলোকিত করতে পারে? উদ্ভাসিত করতে পারে তাদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে? সাহিত্য আসলে সময় ও স্থানের প্রতিবিম্ব।
সাহিত্যের হৃদয় বোঝা খুব দরকার। আমরা প্রায়শই সাহিত্যের হৃদয় না বুঝে তা সৃষ্টি করবার জন্য উৎসুক হই। তাড়াহুড়ো করি। আমরা সম্ভবত মনে করি, শক্তিশালী ভাষা এবং মশলাদার প্লটই যথেষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করতে। অবশ্যই সাহিত্যে ভাষার দক্ষতার দরকার রয়েছে, ভাষার ব্যবহার অবশ্যই জড়িত, তবে শুধুমাত্র ভাষায় নয়, আরও অনেক কিছু প্রয়োজন। অসামান্য সাহিত্য ধ্বংস করে না, তা সৃষ্টি করে, অবিচল করে তা। এটি মানব চরিত্রের অন্ধকার দিকটিতে শুধুমাত্র আলো ফেলে না, চরিত্রের প্রসারণও দেখায়; চরিত্রের ভিন্ন ধাপগুলিকে খুঁজতে থাকে। যে একটি বাড়িকে ধ্বংস করে সে কোনোভাবেই প্রকৌশলী নন, প্রকৌশলী শুধুমাত্র নির্মাণ করেন।
যে সাহিত্যিকেরা নিজেদের জীবনকে সাহিত্য-সৃষ্টির অঙ্গনে সমর্পন করতে চায়, তাদের জীবনে লক্ষ্যের প্রতি থাকতে হবে অবিচল। প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধতার। তারা নিজেদেরকে প্রস্তুত করছে এক দায়িত্বশীল পদের জন্য , যা হয়ত কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চপদে আসীন এক বিচারকদের দায়িত্ত্বের চেয়েও বেশি! ডিগ্রি এবং উচ্চশিক্ষা এ জাতীয় শৈলী এবং সাধনা অনুসরণের জন্য অপর্যাপ্ত। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য-সৃষ্টির জন্য মানসিক অনুশীলনের, তীব্র শৃঙ্খলাবোধের। প্রয়োজন সৌন্দর্য্যের মর্ম - গভীরতার। একজন লেখককে আদর্শবাদী হতে হবে। সাহিত্যের অমর - স্রষ্টা এক সাধারণ জীবনযাপন করেন এবং বিলাসিতা পরিত্যাজ্য বলে বোধ করেন।
সাহিত্যের অগ্রগতি পরিলক্ষিত না হলে এর কারণ আমাদেরই খুঁজে বের করা বাঞ্চনীয়। আর তা করতে হবে বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে । হতে পারে আমরা আমাদের সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিই নি! কয়েকটি ওষুধের সাথে পরিচিত হ'লেই কি আমাদের নিজেদের চিকিৎসক বলে দাবি করবার অধিকার জন্মায়? সাহিত্যের আরোহণ আসলে একটি জাতির আরোহণ, আমরা সর্বশক্তিমানের কাছে সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করব যে আমাদের মধ্যে সত্যের উদয় হোক, উদয় হোক সত্য-সুন্দরের, উদয় হোক সত্য-তপস্যার, উদয় হোক সত্য-আত্মজ্ঞানের এবং উদয় হোক সাহিত্যের সত্য নির্মানের।
সাহিত্যের স্রষ্টাদের কাঁধে এক গুরুত্ত্বপূর্ন দায়িত্ব রয়েছে, রয়েছে এক বিশাল বাধ্যবাধকতাও। যে মুহুর্তে একজন সাহিত্যিক কলম তুলে নিয়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায় এই মহৎ দায়িত্বটি।
জীবনে সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা কখনও কখনও প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি । বলা হয়ে থাকে যে যারা প্রকৃতিগতভাবে পুণ্যবান বা ধার্মিক তারা যা-ই পড়েন না কেন সারাজীবন পুণ্যার্জন করতেই থাকবেন। এবং যারা অধর্মে পরিপূর্ণ তারা যতই পড়াশোনা করুক না কেন, অধার্মিকই থাকবে। এই বিবৃতি খুব সামান্য একটা সত্য ধারণ করে। মানুষের মন স্বাভাবিকভাবেই সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। যতই আমরা ক্ষয়িত হতে থাকি না কেন, আমরা কখনই মন্দের প্রতি আকৃষ্ট হই না। যতই আমাদের মধ্যে নিষ্ঠুরতা থাকুক না কেন, আমাদের মধ্যে সহানুভূতি, ক্ষমা, ভালবাসা এবং নিষ্ঠার এই গুণগুলিও বর্তমান।
সাহিত্য সামাজিক আদর্শের স্রষ্টা। আদর্শগুলি যখন দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পরে, তখন পতন দ্রুত শুরু হয়। আধুনিক সভ্যতার বয়স মাত্র দেড়শ বছর। এমনকি এত অল্প সময়ে, বিশ্ব নতুন ক্রম-বর্ধমান সভ্যতাটিকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। আবার এর কোনো বিকল্পও পথও নেই। এ যে অবশ্যম্ভাবী। এটা এমন একটা অবস্থা যেটাকে একমাত্র কল্পনা করা চলে একজন বে-পথে চলে যাওয়া মানুষের সঙ্গে, মানে, এমন একজন মানুষ যে জানে সে যে পথ নির্বাচন করেছে তা ভুল, কিন্তু তার সেই পথ থেকে ফিরে আসারও শক্তি নেই। তাকে এগিয়ে চলতে হবে, সেই পথ যদি ক্রুদ্ধ, উন্মত্ত সমুদ্রের তরঙ্গের দিকে চালিত করলেও। সে আসলে হতাশার হিংস্র শক্তিতে আবদ্ধ, আশাবাদের বিস্তৃত সাহসের দ্বারা নয়।
প্রকৃতি অনুসারে মানুষ ঈশ্বরবাদী। বিশ্ব-সংসারের ভণ্ডামি ও ছলনার দ্বারা প্রভাবিত বা পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা এই সদর্থক ভূমিকাটি হারায়। সাহিত্য মানব গুণগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে তার মূল জায়গায় - মানব হৃদয়ে। ধর্মোপদেশ বা শিক্ষার মাধ্যমে নয়, আবেগকে উজ্জীবিত করে, হৃদয়ের নরম তন্ত্রীতে আঘাত করে এবং প্রকৃতির সাথে সাদৃশ্য স্থাপনের মাধ্যমে, সাযুজ্য স্থাপনের মাধ্যমে। বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন আত্মার মধ্যে, প্রতিটি দেশ বা একটি জাতির একটি পৃথক আত্মা থাকে। সাহিত্য সেই আত্মার প্রতিধ্বনি।
সাধারণত আমরা আমাদের যৌবনে এক প্রবল ধ্বংসের দিকে স্থির দৃষ্টি রাখি। সংস্কারের আকাঙ্ক্ষায় আক্রান্ত হই আমরা ,আমরা যেন অন্ধভাবে তীর ছোঁড়া শুরু করি, আমরা বাস্তবতার খরস্রোতে নিজেদের চিন্তাভাবনাকে প্রবাহিত করি। আমরা বিবেচনা করি যে শিল্পের পরিপূর্ণতা নগ্ন ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে, যা কিনা আসলে মন্দ বলে পরিগণিত হয়। এটা সত্য যে কেবল একটি বাড়ি ভেঙেই আমরা একটি নতুন বাড়ি তৈরি করতে পারি। অনেক সময় পুরানো বন্ধন এবং ছলচাতুরী ভেঙে ফেলার দরকার হয়ে পরে, তবে এটিকে সাহিত্য বলা যায় না। সাহিত্য তার নিজস্ব অনুশাসনকে অনুসরণ করে।
কোনও ব্যক্তি তার আসল এবং খাঁটি রূপ কোথায় দেখতে পায়? সেটা কি পরম একাকীত্ত্বে ? একেবারে একা এবং এক আনন্দিত মিথ্যার মধ্যে?কৃত্রিমতা এবং অস্থিরতা থেকে বহু দূরে। নির্মুগ্ধের সাথে সত্যের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আমার বিশ্বাস যে সাহিত্যে কেবল একটিমাত্র রস রয়েছে এবং তা হ'ল শৃঙ্গার রস অথবা প্রেমরস। সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, সৌন্দর্য্য এবং প্রেমবিহীন কোনও রসই সত্য রস নয়। যে কোনও সৃষ্টি যার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র প্রবৃত্তি এবং আকাঙ্ক্ষাকে প্ররোচিত করা, এবং কেবলমাত্র অগভীর বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা, কোনও প্রকৃত এবং সত্যিকার সৃষ্টির পরিপন্থী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন