সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভারতে পিকনিকের খাবারের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস / The Diverse History Of Picnic Food In India

 ভারতে পিকনিকের খাবারের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস / The Diverse History Of Picnic Food In India


ভারতে  কিরকম ভাবে হয় পিকনিক। কিভাবেই বা হতো ব্রিটিশ আমলের পিকনিক? মহাভারতের যুগেও কি হতো পিকনিক? 


ভারতে পিকনিকের খাবারের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস / The Diverse History Of Picnic Food In India
পিকনিক: Image Courtesy: Getty Image 



মহাভারত থেকে ব্রিটিশ রাজ - বাড়ির বাইরে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া , না, না কোনো রেস্তোরাঁর কথা বলছি না, বলছি পিকনিকের (picnic) কথা,  বাংলায় চড়ুইভাতি বলি যাকে। ছোটবেলার পিকনিকের স্মৃতি রাজত্ব করছে এখনও,আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু যুগের ঐতিহ্য এই চড়ুইভাতি এখনও টিকে আছে বহু বদলের পরেও।  শুধুমাত্র মেনু পরিবর্তিত হয়েছে,পরিবর্তিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর চরিত্র, ভৌগলিক দূরত্বের সাথে আলাদা হয়েছে বিভিন্ন  চড়ুইভাতির রকম - সকম, খাবারের মেনুর।


আশি কিংবা নব্বই দশকের প্রকাশিত হওয়া কোনো গল্পের সিরিজে, সিরিয়ালে, উপন্যাসে, কিংবা রম রম করে  হল গুলোতে চলা সিনেমাতে  পক্ষে মেয়েদের রঙিন মাসিক পত্রিকাতে  পিকনিকের উল্লেখ , ছবি থাকতই থাকত। বড় বেলায় দেখে ছোটবেলার পিকনিকের ছবি। কিন্তু  একটা জিনিস নিয়ে দুঃখ আমার বরাবরই থেকে  গেছে , ছোটোবেলার পিকনিকগুলিতে রঙ্গিন বাহারি ম্যাগাজিনের ছবির মতো বিভিন্ন ধরণের পেস্ট্রি, রকমারি কেক, সুস্বাদু স্যান্ডউইচ ছিল না ! হতে পারত তা বাড়িতে বানানো কিংবা কোনো বড়সর দোকান থেকে কেনা।  নিশ্চিতভাবে ওইসব ম্যাগাজিনের দুর্দান্ত ছবির মতো কিছুই ছিল না।    আমার চিরন্তন আফসোসের সেই ছোটোবেলার  পিকনিকের ঝুড়িতে সাধারণত হালকা টোস্ট করা , আবার কখনও সেটাও নয়, পাঁউরুটি - সবার ভাগে চার পিস করে বরাদ্দ ছিল। একটি শক্ত করে সেদ্ধ করা ডিম, একটি কলা এবং জয় নাগরের মোয়া -  খই, খোয়াক্ষীর আর খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি মিষ্টি - কিরকিরে মিষ্টি !  আমি একমাত্র  সিদ্ধ ডিমটা খাব, দুটো পাঁউরুটি খাব হয়ত। একটা কলা খেতেও পারি। মিষ্টিটা অন্য কাউকে দিয়ে দেব।  সাধারণত, রুটির কোন গ্রহণকারী ছিল না, তাই চার পিস খেতেই হতো।


এর মানে এই নয় যে আমাদের পিকনিকের কোনো খাবারই দুর্দান্ত  ছিল না।  ছিল তো, রঙিন ছেলেবেলার মজায় মাখা ছিল সেই খাবার ভর্তি প্লেটগুলো, দুপুরের খাবারের নতুন নতুন মেনুর আয়োজন ছিল। শুধু দুপুরের খাবার কেন, মাঝেমধ্যে পিকনিকের সকাল বেলার লুচি খাবার  কিছু উত্তেজনাও তো ছিল। শীতের রবিবারে, বৃহৎ যৌথ পরিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে সবুজ ময়দানে, শহরের প্রান্তে থাকা বিভিন্ন বাগানবাড়িতে বিভিন্ন রঙ এবং আকারের ক্যাসারোল নিয়ে উপস্থিত হয়ে যেত।  কিংবা, বাসন - কোসন, বিরাট বিরাট হাঁড়ি- ডেকচি, হাতা - খুন্তি আর কাঁচা সবজি বাজার, পাঁঠা বা মুরগির মাংস নিয়ে। মা - মাসি - পিসি - দিদিরা আনাজ কাটা আর  রান্নার তত্ত্বাবধানে। বাড়ির পুরুষেরাও হাত লাগাত সাথে। 


বাঙালি শীতের পিকনিকের খাবারের মেনুতে সাধারণত থাকত, ডিম- কলা- পাঁউরুটি বাদ দিলে,  শুকনো আলোর দম বা ডিমের ঝাল ঝাল তরকারি, করাইশুঁটির কচুরি বা ফুলকো থেকে  ক্রমশ নেতিয়ে যাওয়া লুচি সাথে কখনও কখনও বাজেট বেশি থাকলে মোচার চপ, গাজর ও বিট  দিয়ে তৈরি ভেজিটেবল চপ, মাছের চপ ইত্যাদি, আর মিষ্টি তো অবশ্যই - জলখাবারে থাকে সন্দেশ, বোদে এইসব।  বড়দের জন্য  চা বা কফি- ফ্লাস্ক থাকাটা অবশ্য কর্তব্য। বাচ্চাদের জন্য থাকত আমের ফ্রুটি।শুধু, থাকত বলা ভুল, এখনও অনেকেই যারা পরিবার নিয়ে পিকনিক করতে যান তারা সকালের জলখাবারে এই মেনুটাই পছন্দ করে।


খোলা জায়গা, বাগানবাড়ি ছাড়াও  আজকাল রিসোর্ট (resort) বুক করে পিকনিক হয়। রিসোর্ট গুলোতে অবশ্য ঠিক পিকনিক না, একটা গেট টুগেদার (get together) বলা যেতে পারে সেগুলোকে। কোনো কোনো পিকনিকে আবার নিজেরা রান্না বান্না করতে হয় না, ক্যাটারিং বলা হয়।  পার্থক্য হল, সেখানে কিছুটা খোলা আকাশের নীচে আড্ডার পরিবেশ তৈরি হয়। সারাবছর বাড়ির কাজ আর অফিস সামলে  কারোরই আর খাবার তৈরিতে মন আর শরীর কোনোটাই সাথ দেয় না।   ভাড়া করা শামিয়ানার নীচে ক্যাটারিং সার্ভিস (catering service) এর ছেলেরা দুপুরের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পরে। একটির পর একটি সুস্বাদু পদ। সরু চালের গরম ভাত,  মাছের মাথা দিয়ে রান্না করা মুগ ডাল, ঝুরো আলু ভাজা, পনিরের তরকারি কিংবা পটলের লাল ঝোল,বাঁধাকপির ঘন্ট, রুই বা কাতলা মাছের কালিয়া - কখনও ভেটকি পাতুরি।   খাবারের এই পদগুলোর মধ্যে হাইলাইট হল একটি লালচে-বাদামী মাটন বা চিকেন কারি। যার উপরে গরগরে তেল ভাসবে আর ক' টুকরো মাংস পাতে পরবে সেটা নিয়ে মনে মনে হিসেব চলে।  সব পরিচিত খাবার যা আমরা সারা বছরই খাই - তবে শীতের সূর্যের নীচে এর স্বাদ আরও যেন ভাল খোলে।


তবে, আগের যুগে এত রান্নার মেনু বোধহয় রাখা হতো না। গরম ভাত, আলু ভাজা, সবজি দিয়ে মুগ ডাল, মাছ ভাজা, মটন কিংবা চিকেন কারি, চাটনি। এইগুলোই খেতাম আমরা। ওহ, বলতে ভুলে গেছি চাটনি, দই, পাঁপড়, মিষ্টি এখনকার ক্যাটারিং সার্ভিসে দেওয়া হয় অবশ্য। 


রিসোর্ট এ পিকনিক হলে চিকেন স্যান্ডউইচ, ফিশ ফিঙ্গার, মাটনের বিভিন্ন আইটেম দেয়। ব্রেকফাস্ট এ। আর লাঞ্চ এ কন্টিনেন্টাল, মোঘলাই, এসবও সার্ভ করে। এটি ঠিক বিখ্যাত পিকনিকের খাবার নয়। রিসোর্ট এর পিকনিক কবেই বা পিকনিক হলো!  গেট টুগেদার বলা যেতে পারে।


ঔপনিবেশিক বা কলোনিয়াল (colonial) কলকাতার  অতীতের পিকনিকের কথা বলি একটু, ক্লাব গুলোতে পিকনিক হতো। বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা দেখা যেত।  পটলাক (potluck) পিকনিক ছিল খুবই জনপ্রিয়। ব্রিটিশ কলোনিয়ালিস্টদের (colonialists) জন্য “one of the chief forms of social activity” -অন্যতম প্রধান সামাজিক কার্যকলাপ।  “the british took their wilful picnicking with them when they colonized india,” - ব্রিটিশরা ভারতে উপনিবেশ গড়ার সময় থেকেই যেন নিজেদের পিকনিক করার হবিটা সাথে নিয়ে এসেছিল, এমনটাই লিখেছেন ইতিহাসবিদ মেগান এলিয়াস ( Megan Elias ) তার ২০১৪ সালে প্রকাশিত বই -   " Lunch: A history"  - লাঞ্চ - এ হিস্টোরি তে।   তাদের পিকনিকের ঝুড়িতে বা বাস্কেটে (busket) থাকত ইউরোপীয় এবং ভারতীয় খাবারের মিশ্রণ: ঠান্ডা হ্যাম (ham) ও টং ( tongue),  নান বা পরাঠা, স্টিমরোলার চিকেন ( Steamroller Chicken) ( মুরগির ফিললেটগুলিকে (fillet) টুকরো টুকরো করে ভাজবার আগে চ্যাপ্টা করে নেওয়া হতো), আলুর কাটলেট বা রিসোল (rissoles), সসেজ (sausages), মশলাদার গরুর বা শুয়োরের মাংসের একটা পদ  , লেটুস এবং টমেটো দিয়ে স্যালাড, আলফোনসো আম, কখনও সখনও দেশী পদ্ধতিতে তৈরি কুলের টক ঝাল আচার, কিংবা গোটা কুলের মতো ফল খাদ্যতালিকায় থাকত।


এই পিকনিক ছিল রীতিমতো এলিট শ্রেণীর ব্যাপার - স্যাপার। লেখিকা জেনিফার ব্রেনান (Jennifer Brennan) কারি (curry) এবং বাগলস (bugles) -এর মত স্নাক্স (snacks) এর বর্ণনা করেছেন। ব্রিটিশ রাজের সময়কার একটি স্মৃতিকথা এবং রান্নার বই এর কথা বলেছেন। সেখানে বর্ণনা কিছুটা এরকম -  “snow white tablecloths, silver cutlery, crystal glasses and finger bowls” - সাদা টেবিলক্লথ, সিলভার কাটলারি, ক্রিস্টাল গ্লাস এবং আঙুল ধোয়ার বাটি সহ শ্যাম্পেন পরিবেশনকারী পরিচারিকা - পরিচারক এই পিকনিকের সময় উপস্থিত থাকত। যদিও এই পিকনিক সজ্জা সাহেবদের একটা শো অফ মাত্র। 


                       প্রিন্স অফ দ্য হাউস অফ তৈমুর ( princes of the house of timur) : আব্দ                          আস - সামাদ (abd as-samad,) ১৫৫০ - ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ. Image Courtesy:           british museum/wikimedia commons [public domain]. 



আচার-অনুষ্ঠানে চড়ুইভাতি: 


রাজা- রাজরাদের জন্য আয়োজিত চড়ুইভাতি আসলে নিজেদের প্রাচুর্য্য এর উদযাপন ছিল বরাবরই, উপলক্ষ্য থাকত  রাজকীয় খানাপিনা, আর সেটা হতো বেশ বাড়াবাড়ি রকমের!  কিন্তু সাধারণের কাছে পিকনিক হল  প্রকৃতির সাথে, প্রকৃতির মাঝে কাছের, ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া আর সময় কাটানো। তাদের সহজাত আগ্রহের মূলে ছিল একে অন্যের সঙ্গে আদান প্রদানের ভাবনা।  ভারতের অনেক অংশে, প্রকৃতপক্ষে, প্রকৃতির মাঝে একসাথে খাওয়া দাওয়ার এই কাজটিকে আচার-অনুষ্ঠানে সংযোজিত করা হয়েছে । প্রায়শই চড়ুইভাতির আয়োজন করা হয়। প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপনের এবং বিশ্রাম-ও-পাচন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত করবার  করার জন্য এটি একটি পর্যায়ক্রমিক অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে।


তামিলনাড়ুতে, আদি (aadi) তামিল মাসের ১৮ তম দিনে - ইংরেজিতে জুলাই - আগস্ট মাসের , মানুষজন কাভেরী নদীর তীরে বা অন্য কোনও নদীর পাশে জড়ো হয় আদি পেরুক্কু ( adi perukku) উদযাপন করতে, বর্ষার সূচনা, জলের উত্সকে উত্সর্গ করে।  অনুষ্ঠানটি নদীর তীরে আল ফ্রেস্কো (al fresco) পিকনিক দ্বারা অনুসৃত, অনুসরণ করা হয় এই প্রথাকে। যেখানে বিভিন্ন ধরণের মশলা ব্যবহার হয় খাবার , বিভিন্ন্ স্বাদের ভাত থাকে – লেমন রাইস, ট্যামারিন্ড রাইস, কোকোনাট রাইস, কার্ড রাইস ইত্যাদি। এগুলি কলা পাতায় খুব সহজেই পরিবেশন করা এবং খাওয়া যায়। 


অন্ধ্রপ্রদেশে, কার্তিক মাসের সব থেকে বড় অনুষ্ঠান  হল কার্তিকা বনভোজানালু (kartika vanabhojanalu)। একটি ধর্মীয় রীতি অনুসারে এই পিকনিক হয়। কিছু রীতি যেখানে কিনা আমলকী  গাছের নিচে খাওয়া - দাওয়া করাটা বাধ্যতামূলক।  হিন্দু পুরাণ মতে, এবং লোক বিশ্বাসে বলা হয় যে আমলকী হল দেব প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি গাছের মধ্যে একটি, যেখানে দেবতারা বাস করেন এবং এর নীচে খাওয়া দাওয়া করলে শরীরকে পবিত্র করে।  কার্তিকা বনভোজানালুতে ঐতিহ্যগতভাবে যে খাবার পরিবেশন করা হয় তা হল, নিরামিষ খাবার সবই: পুলিহোরা ( pulihora) বা তেঁতুল ভাত, খাস্তা ভাদিয়ালু (vadiyalu) , পুন্নুকুলু ( punnukulu) বা ভাজা, মিষ্টি পুর্নালু (purnaloo), সুস্বাদু একটি কারি, মশলাদার মসুর ডাল এবং ভাত।



বর্ষাকালে তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলিতে জলপ্রপাতগুলোর কাছে   পিকনিক করার একটা লেগাসি ( legacy) বা ঐতিহ্য রয়েছে । আর এই পিকনিক তার নিজস্ব ঘরানার রান্নার জন্ম দিয়েছে।  নারকেলের দুধ দিয়ে ভাত, তেঁতুল ভাত,  মাংসের কোনো একটা পদ, পেঁয়াজ রায়তা এবং বেগুনের চাটনির মতো খাবারগুলো, যেগুলো কিনা টিপিক্যাল (typical) তিরুনেলভেলি পিকনিকের খাবার হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। খাবার হয় বাড়ি থেকে আনা হয় কিংবা পিকনিকের স্পটের (spot) অস্থায়ী তাঁবুতে রান্না করা হয়। এই অঞ্চলের জনপ্রিয় গন্তব্যগুলির মধ্যে হল কুট্রালাম - জলপ্রপাত এবং আম এবং নারকেল গাছ দিয়ে ঘিরে থাকা একটি শহর যা  পিকনিকের জন্য আদর্শ জায়গা। অপরিহার্য যে খাবারগুলো এই পিকনিকের তা হল - কুত্তালা (kuttala) নামে একটি চাটনি যা নারকেল, শুকনো লাল মরিচ, তেঁতুল, রসুন এবং সরিষা দিয়ে তৈরি করা হয় । 



ভারত জুড়ে, প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব পিকনিক হয় আর এই প্রত্যেকটি পিকনিকের রয়েছে আলাদা আলাদা  খাবার ।  ক্লাসিক (classic) পাঞ্জাবি পিকনিকের খাবার হল সুখে আলু, ভারভে করেলে এবং নমক-আজওয়াইন কে পরাঠে।  পরোটায় মসলাদার আলুর পুর ভরে  বা সবজি দিয়ে রোল করে নেওয়া হয়, সহজে তৈরি করাও যায়। পশ্চিমভারতে, সাধারণ গোয়ান পিকনিকের খাবার হল চাটনি স্যান্ডউইচ, সল্টেড বিফ টং স্যান্ডউইচ (salted beef tongue sandwiche) এবং নরম পানীয় (soft drink)- সবইগুলোই পিকনিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুবিধাজনক আর খেতেও উত্তম।



বাড়ি থেকে খাবার আনার পরিবর্তে, খোলা আকাশের নিচেই পিকনিক স্পটে  রান্না করতে পছন্দ করে বহু, বহু মানুষ,  কালচারাল প্রেফারেন্স (cultures preference) যাকে বলে ।  জানুয়ারী থেকে মে মাসের মধ্যে, যখন উপকূলীয় মহারাষ্ট্রে ভাল মটরশুটি কাটার সময় হয়, তখন অনেক গ্রামীণ সম্প্রদায় পপটি পার্টির (popti party) আয়োজন করে।  এই উপলক্ষ্য গুলিতে, একটি ওয়ান পট ডিশ ( one pot dish) তৈরি হয়, ভাল (vaal) বিন, মটরশুটি, সিদ্ধ ডিম, আলু এবং বেগুনের মতো মরশুমের সবজি আর আগের রাতে মশলা দিয়ে মেরিনেট করা রাখা মাংস  তৈরি করা হয়।  যে পাত্রে রান্না করা হয় সেই মাটির পাত্রটি ঔষধি ভুমব্রুট (bhambrut) পাতা দিয়ে বন্ধ করা হয়, অসম্ভব সুস্বাদু খাবার - কুলিনারি ডিলাইট (culinary delight) যাকে বলে, সিল করা হয় এবং একটি অগভীর গর্ত খুঁড়ে সেই হাঁড়ি টিকে উল্টো করে রাখা হয়, একটু উঁচিয়ে রাখা হয় যাতে  আগুন দিলে , সেই ধিমে আঁচে রান্না হয়ে যায় ।



বাংলায়, ঐতিহ্যবাহী পিকনিক,  চড়ুইভাতি যাকে বলা হয়, প্রায়ই স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার ছিল বা আছে সেই চড়ুইভাতি গুলোতে, খোলা জায়গায় একসঙ্গে রান্না করার কাজকে কেন্দ্র করে যেন একটা উৎসব। শীতকালে বার্ষিক চাঁদা দিয়ে পিকনিক ছাড়া, প্রায় প্রায় আবার ঘরোয়া পিকনিক ও হতো, এখানে কোনো চাঁদা দেওয়া হত না, প্রত্যেকে বাড়ি থেকে একটি করে কিছু নিয়ে আসত, কেউ চাল কেউ ডাল কেউ সব্জি নিয়ে আসত এবং একটা সাধারণ ধরণের খাবার তৈরি হতো- খিচুড়ি- আলুর দম - ডিমের ঝোল - ভাত ইত্যাদি। রান্নার দায়িত্ব ভাগ করে নিত।  মহিলারা  আনাজ কাটত,  আর পুরুষরা রান্নার দায়িত্ত্ব নিত। 


প্রাচীনকালের বনভোজন  : 



ব্রিটিশ সাহেব এবং ঠাণ্ডা শ্যাম্পেন ভারতে আসার কয়েক শতাব্দী আগে, ভারতীয়রা তাদের নিজস্ব উপায়ে চড়ুইভাতির আয়োজন করত।বিনোদনই ছিল মুখ্য। উপভোগ করত বন্ধু বান্ধব আত্মীয় পরিজন সহকারে।  ধ্রুপদী ভারতীয় শিল্প ও সাহিত্যে পিকনিকের অল্পবিস্তর বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে মূলত উচ্চশ্রেণীর জন্যই ছিল এই পিকনিকের ব্যবস্থা।  বাগান পার্টিরও আয়োজন করা হতো। প্রাচুর্যের বিচ্ছুরণ ঘটত সেসব আয়োজনে।   কৌশাম্বীতে আবিষ্কৃত শুঙ্গ যুগের (১৮৫- ৭৩ খ্রিস্টপূর্ব) একটি টেরাকোটা ভাস্কর্য পাওয়া গেছে।   বিনোদ চন্দ্র শ্রীবাস্তব তার ভারতের কৃষির ইতিহাস (History Of Agriculture In I),বইতে লিখেছেন , ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের এই পিকনিকের উদাহরণ দিয়েছেন - “portrays a picnic party moving in a chariot” । মাঝখানে একটি বড় থালায় যা খাবার ছিল তারও বর্ণনা দিয়েছেন -  “cooked food with clear suggestion of rice, sweet balls, round cakes, etc.,” ।


মহাভারত একটি বনভোজনের  জমকালো বর্ণনা আছে। এই বনভোজন অভিযানকে শুধুমাত্র  টিউটনিক নাইটদের (teutonic knights) ক্যারোসেলের (carousels) সাথে তুলনা করা যেতে পারে।  


কৃষ্ণ, বলরাম এবং অর্জুন উপস্থিত ছিলেন এই বনভোজনে এমনই কথিত আছে।  বনভোজনে সমস্ত ধরণের মদ পরিবেশিত হচ্ছিল।  কাদম্বরী (kadambhari) ছিল, পাকা কদম্ব থেকে তৈরি করা, কদম্ব অর্থে কলা;  মাধভিকা (madhavika) ছিল, মহুয়া ফুলের  পাপড়ি থেকে তৈরি;  ছিল আরক;  এবং ছিল এক প্রকার বিশেষ মদ যা কিনা  সুগন্ধি ফুল দিয়ে তৈরী করা হতো।  পিকনিক এর   বৈশিষ্ট্য ছিল  রোস্ট করা মাংস এবং অতি সুস্বাদু মাংসের কারি;  তেঁতুল এবং ডালিম দিয়ে তৈরি সস;  বিভিন্ন রকমের টক জাতীয় লতাগুলম, শাঁস, আম এবং মশলা দিয়ে সিদ্ধ করা প্রচুর পরিমাণে হরিণের মাংস; এবং ঘি দিয়ে সাজানো এবং মুলো, লেবু, মিষ্টি তুলসী, হিং, ডালিম এবং আরও অনেক কিছু দিয়ে সাজানো বিভিন্ন পাখি ও পশুর মাংস।  একটি তরতাজা মহিষকে পোড়ানো হত, রোস্ট যাকে বলে, তারপর তাকে ঘি মাখিয়ে খাওয়া হতো ।  প্রচুর পরিমাণে মিষ্টির পদ রাখা হতো, উৎকৃষ্ট দুধ সমৃদ্ধ মিষ্টান্ন যেমন ঘৃত পূর্ণক (ghrita purnaka), চিনি, ময়দা এবং ঘি দিয়ে তৈরি যাকে বর্তমান ঘেওয়ারের পূর্বসূরি বলা যেতে পারে।



বাৎসায়নের কামসূত্র, খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে রচিত, উদ্যান যাত্রা বা দিনব্যাপী বাগান পিকনিকের বর্ণনা দেয় যা ধনী ব্যক্তিরা এবং তাদের গণিকাদের সঙ্গে নিয়ে  উপভোগ করত, নানা আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা থাকত সেখানে। যেখানে পরিচারক-  পরিচারিকার একটি দল তাদের খাবার পরিবেশন করতো।  শেষে, বনভোজন কারীরা স্থান স্মরণের চিহ্ন হিসাবে তাদের সাথে একটি ডাল, পাতা বা বনফুল  নিয়ে ফিরে যেত।


মুঘল সম্রাট এবং তাদের দরবারীদেরও বনভোজনে অংশ গ্রহণের কথা পাওয়া যায়।  তাদের পুষ্প শোভাময় ও পত্রগুলম দ্বারা সুসজ্জিত বাগানে বনভোজনের আয়োজন হতো। কখনও কখনও চাঁদের আলোতেও বনভোজন হতো।  পার্সিয়ান শিল্পী মীর সাইয়িদ আলীর ১৬  শতকের বিখ্যাত চিত্র, তৈমুরের বংশধর সিরিজের যে চিত্র তিনি এঁকেছেন  সেখানে হুমায়ুনের বাগান বিলাস ও বনভোজনের চিত্র উঠে এসেছে।  রাজকীয় পোশাক অভিহিত  চাকররা চিনার গাছের ছায়ায় বসে থাকা অতিথিদের জন্য খাবার ও পানীয় পরিবেশন করত।



একটি রাজকীয় জাঁকজমক পূর্ন বনভোজনের একটি সাম্প্রতিক বিবরণ প্রতিকৃতি শিল্পী চার্লস বাস্কারভিল (charles baskerville) দিয়েছেন ।  তিনি বলেন, ১৯৩৭ সালে জয়পুরের মহারাজা \ পিকনিকের আয়োজন করেছিলেন যার জন্য দুপুরের খাবার একটি লরিতে পাঠাতে হয়েছিল।  সেদিন মেনুতে ছিল ইউরোপীয় খাবারের সাথে ভারতীয় খাবারের ভাণ্ডার, যেমন শুয়োরের মাথার ঠান্ডা তরকারি (চোখ ছাড়া) এবং পালং শাক গুঁড়ো করা মরিচের পাতা দিয়ে   ভাজা।   বাস্কারভিল বলেছেন  সাথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, “of course, a hamper of whisky, beer, gimlets, cider and water” ।



প্রতি বছর শীতকালে,  এখনও পিকনিক করে সবাই। কেউ পুরো পরিবার নিয়ে করে কেউবা বন্ধু বান্ধব নিয়ে। না হলে যেন শীতটা যেন ঠিক জমজমাট বলে মনে হয় না। পিকনিক, বইমেলা, নানা রকমের হস্তশিল্প মেলা, খাদ্য মেলা এই সব নিয়েই তো বাঙালির শীতকাল। এর একটা কম পড়লে কি চলে?  










মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস বা মগ্নচৈতন্য / What is Stream of Consciousness?

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস ? সাহিত্য ধারায় এটি এক রীতি, বলতে গেলে লেখনীর এক ধরণ। সাহিত্যের আলোচনায়  কিংবা সমালোচনায় 'স্ট্রিম অফ কনসাসনেস'- ‘Stream of Consciousness’  বা মগ্নচৈতন্য শুধুমাত্র এক শব্দ নয়, এ এক অনন্য, এক স্বতন্ত্র জঁর  ।  মগ্নচৈতন্যের   স্রোত সাহিত্যসৃষ্টির এক অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন ধারা,  যা কিনা  বিংশ শতাব্দীর কিছু বিখ্যাত লেখক   নিযুক্ত এক স্বতন্ত্র লেখন রীতি। নিজেদের লেখনীতে কিছু ঘটনা পরম্পরাকে  বর্ণনা করতে ব্যবহার করেছিলেন তারা ।  কিন্তু '  মগ্নচৈতন্য '  কী?  কেনই বা  এটি একটি 'ধারা' বা ' জঁর' ?  কিছু  পরিচিতি দিলাম বটে শুরুতে কয়েকটি শব্দকে আশ্রয় করে, তবে  বিস্তারিত আলোচনা  এগোবে আস্তে আস্তে।  এই আপাত সাধারণ এবং একইসঙ্গে ব্যাপকভাবে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা যুক্ত , সাহিত্যিক টার্মটির ধারণা  পরিষ্কার করতে সহায়তা করতে পারে হয়ত এই  আলোচনা ।   Image Courtesy: Steve Jhonson:pixels.com/free image প্রকৃতপক্ষে, ' মগ্নচৈতন্য  '   সাহিত্যের  জঁর  হিসাবে একেবারেই শুরু করেনি    তার  জীবন !  তবে ?   অবাক করা তথ্য এই  যে - সম্ভবতঃ এটি ছিল   এ

বাংলা অণুগল্প- অনুগল্প সিরিজ /Bengali Story

অসীম আর মাধবীলতা অসীম.....এই যে এই দিকে, মাধবীলতা আবার ডাক দিলো,....... হ্যাঁ একদম ঠিক যাচ্ছ,......আমার হাতটা লক্ষ্য করে আস্তে আস্তে এগিয়ে এস, না না ওদিকে নয়.......ওদিকে কাঁটার ঝোপ......গায়ে ফুটে গেলে কেলেঙ্কারির একশেষ.....মাধবীলতা আর ভরসা রাখতে পারলো না, নিজেই এগিয়ে গিয়ে অসীমের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। অসীমের জামাকাপড় ভিজে জবজব করছে। একজায়গায় থামলো তারা, বেশ নির্জন, একটা বাড়ির ভিতরে ঢুকে এল। একটু পুরোনো বাড়ি কিন্তু বসবাসের যোগ্য। মাথাটা মুছে নাও, বেশ ভিজেছ, ঠান্ডা ব'সে গেলে জ্বর আসতে পারে....মাধবীলতা হাতের মুঠো ছেড়ে দিয়ে একটা গামছা এগিয়ে দিল। .অসীম গামছাটা নিয়ে সামনে খোলা জানালার বাইরের পুকুরটার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। মাধবীলতার শাড়ির আঁচলের একটা অংশ একটু দেখা যাচ্ছে। ওদিকটায় বোধহয় কাঁটাঝোপ ছিল. কালকের মধ্যে দুটো লাশ ই ভেসে উঠবে আশা করা যায় । -------------------------------------------- ছ'য়ে ছটাক : অনুগল্প ১. জানালাটার গ্রিলের মধ্যে দিয়ে নিজের চার হাত পা বের করে দিল সে, এবার শেকল দিয়ে বাঁধার কাজ শুরু হবে। ২.আমার পেনের কালিটা ধীরে ধীরে শেষ