একটি দিন
''দাদু, ও দাদু, সৈন্য কি গো?''- একটু চমকে উঠলো তামলিং। হাতের কাজটা থামিয়ে তুয়াংলিংয়ের দিকে তাকালো মুখ তুলে ।
'' এই কথা কোথা থেকে জানলে দিদিভাই?''
'' ওই তো, বাজারে গেছিলাম আজকে , সেখানেই তো সবাই বলাবলি করছিলো, সৈন্যরা নাকি আজকে মাঙ্গোগিরির নেতা শিশিমারাকে ধরে নিয়ে গেছে। মাঙ্গোগিরি কি গো দাদু, আর নেতা মানে কি ? ওই শিশিমারা সে কে গো ?''
এত প্রশ্নের সামনে প'রে তামলিং এর মুখে জোগায় না কথা ।
বাড়ির সামনে বসে গাছগুলোকে পরিচর্যা করছে বুড়ো তামিলিং। তারপর করবে বাগানের পরিচর্যা। সবজি বাগানে বুড়ো তামলিং সবজি ফলায়। সারা বছরের পরিবারের খাবারের জন্য সবজি এখন থেকেই আসে যে । পরিবার বলতে বুড়ো তামলিং, তার বৌ বুড়ি তুয়ানকে এবং দুটো নাতি নাতনি তুয়াংলিং আর শিনবোনা। আরো দুজন ছিল এই পরিবারে, যাদের কথা ভাবতে গেলে....
'' ও দাদু, কি গো চুপ করে রয়েছো কোনো ?''
বুড়ো তামলিং তাকালো উদাস চোখ তুলে , সামনে দাঁড়িয়ে তুয়াংলিং ,চোখে কৌতূহল।
'' যা জানতে চাইছো দিদিভাই, সে কথা বলতে গেলে অনেক গল্প বলতে হয়। ''
''গল্প, কিসের গল্প গো দাদু ? ''
'' সে এক বীরের গল্প, এক বীর যোদ্ধা ছিল। ....'' গল্প শুরু করল বুড়ো তামলিং।
আপনারাও কি শুনতে চান তাদের গল্প ? তাহলে শুনুন সবাই।
অনেক কাল আগেকার কথা। ছিল একটা দেশ। এই আমাদের পৃথিবীরই একটা দেশ। নাম কি দেশটার ? এটাই জানতে চাইছেন তো? নাম তো অবশ্যই আছে। ধরে নিন দেশটার নাম জিয়ানগংগা।
এই জিয়ানগংগাতে ছিল এক গ্রাম, সেই গ্রামের নাম ধরে নেওয়া যাক পিনকুট, আর সেই পিনকুট গ্রামের ছেলে, নাম তার তিয়ানশুক। লেখাতে পড়াতে, খেলতে-ধুলাতে সে ছিল এক করিৎকর্মা ছেলে। বড় চমৎকার ছিল তার ব্যবহার। বাচ্চা -বুড়ো সবার সঙ্গেই সে কথা বলত হেসে হেসে । প্রতিদিন সকালে সে চলে যেত বাড়ির পাশের জঙ্গলে , সেখানে সে কথা বলত পাখিদের সঙ্গে , পশুপ্রাণী যারা ছিল সেই জঙ্গলে তাদের সঙ্গে করত খানিক গল্প । বাড়ির পাশেই ছিল এক নদী। সেই নদীতে খেলা করত নানা রঙের মাছ। তারাও বন্ধু ছিল তিয়ানশুকের। একটা ছোট বাড়িতে থাকত তিয়ানশুক। সাথে থাকত বাবা আর মা। পড়ত সে গ্রামের স্কুলে । প্রথম হতো প্রতিটি ক্লাসে। এমন মেধাবী কেউ দেখেনি। জানা- অজানা নানা বিষয় জানত চাইত সে, হেডস্যার শোনাতো তাদের বিভিন্ন দেশের খবর ।
স্কুলের শেষ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ছেলে চাইল কলেজে পড়তে। কিন্তু কলেজ তো গ্রামে নেই। সে তো আছে রাজধানীতে। আর রাজধানী গ্রাম থেকে বহুদূরের পথ। কি হবে এবার ! বাবা- মায়ের মাথায় হাত। এত দূরে ছেলেকে একা একা ছেড়ে দেওয়া! সম্ভব কিভাবে ? কেউ তো থাকে না রাজধানীতে। মন সায় দেয় না বাবা -মায়ের । মন খারাপ তিয়ানশুকের । স্কুলের হেডস্যার বোঝালো- '' তিয়ানশুক আমাদের খুব ভালো ফল করেছে, আরো পড়তে যে চায় সে, পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া ভালো নয়। আর সে যদি আরো লেখাপড়া করে মস্ত চাকরি করে, তাহলে নাম হবে তার চারিদিকে। গ্রামের মুখ হবে উজ্জ্বল। ''
একে একে গ্রামের গন্যমান্য সবাই এসে বোঝায়।
বাবা-মা রাজি হয়। তিয়ানশুক চললো রাজধানীতে। সেখানে আছে মস্ত কলেজ। সেখানে ভর্তি হতে হবে যে।
এসে পৌঁছালো তিয়ানশুক রাজধানীতে; কোথায় রাজধানী ? তা ধরা যাক রাজধানী হ'লো রারাউঙে । ব্যাপারে এ তো বিরাট ব্যাপার! এ যে চিন্তারই বাইরে! কি বিরাট সব বাড়ি, কত উঁচু, কত লোক না জানি সেখানে বাস করে! আর কি সব চওড়া চওড়া রাস্তা!
আর রাস্তায় কত গাড়ি! তিয়ানশুক বইতে পড়েছে বটে এই সব কিছু! এখন দেখছে সে নিজের চোখে। সে চলে গেল কলেজে। প্রথম হয় ছেলে। ভর্তি হতে কিছুমাত্র অসুবিধা হলো না তার। কিন্তু থাকবে কোথায় সে? তার ব্যবস্থাও আছে বৈকি। গাঁয়ের মোড়ল মশাই একখানা চিঠি করে দিয়েছেন যে। রাজধানীতে থাকে তার ভাই। ভাই কাজ করে জুতোর কারখানায়। সেখানেই হবে তিয়ানশুকের আস্তান।
প্রথমদিন গেল কলেজে ; কলেজ এই দেশের সেরা কলেজ। সব সেরা ছাত্রছাত্রীরা আসে পড়তে এখানে। দেশের কত জায়গা থেকে পড়তে এসেছে কত কত ছেলে মেয়ে। তিয়ানশুক দেখে। স্কুলে ভালো ফল করা ছাত্র-ছাত্রী সবাই। কথা বলে তারা কত কিছু নিয়ে । তিয়ানশুক অবাক হয়ে শোনে। কত বিষয় নিয়ে তর্ক করে তারা। তিয়ানশুক বোঝার চেষ্টা করে। এত বিষয় আছে ? তার আরো জানা দরকার। আরো অনেক বিষয় বোঝা দরকার। কোনো বন্ধু হয় নি তিয়ানশুকের । নতুন এসেছে সে। শহরের আদব কায়দা অভ্যাস করতে সময় লাগবে যে তার। একা একাই ঘুরে বেড়ায় সে, ক্লাস করে আর যায় লাইব্রেরিতে। সেখানেই কাটিয়ে দেয় ঘন্টার পর ঘন্টা। কত বই লাইব্রেরিতে। কত বিষয় জানার আছে, কত বিষয় বোঝার আছে। গ্রামের স্কুলে এত বই পড়ার সুযোগই হয় নি। গ্রামে ভালো লাইব্রেরি নেই যে।
তিয়ানশুক পড়তে থাকে, রাজনীতি থেকে সমাজনীতি। জীববিদ্যা থেকে পদার্থবিদ্যা। কোনো বই সে বাদ দেয় না।
এমনি একদিন ক্লাস শেষ হবার পরে, লাইব্রেরিতে গিয়ে বইয়ের মাঝে ডুবে আছে। হঠাৎ একটা মৃদু ডাক;
'' তোমার কাছে কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইখানা আছে। লাইব্রেরিয়ান বললো ওখানা তুমি নাকি নিয়েছো সপ্তা খানেক আগে, ফেরত দাও নি এখনো। বই খানা আমার একটু লাগতো। ''
বেশ দৃপ্ত ভঙ্গিতে যে কথা গুলো বলল তার দিকে তিয়ানশুক একবার তাকিয়ে দেখলো। তাদের ক্লাসের ছাত্রী , তিতিয়ানা। খুব মেধাবী। তিয়ানশুকের থেকেও। শিক্ষকরা যা প্রশ্ন করে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করে দেয়।
'' হ্যাঁ , আমার কাছেই আছে বইখানা। কিন্তু এখন তো সঙ্গে নেই। আমি সঙ্গে আনিনি। কাল এনে লাইব্রেরিতে জমা করে দেব। তখন নিয়ে নিও। ''
তিয়ানশুক তাকিয়ে দেখলো তিতিয়ানাকে। সুন্দর দুটি চোখ। কি বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। সে চোখে জিজ্ঞাসা যেন লেগেই আছে। সে দেখেছে তিতিয়ানা কে ক্লাসে শিক্ষকদের কত প্রশ্ন করে। সব কিছুর উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত যেন মেয়েটি।
সেদিনের মতো লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো সে।এরপর সোজা বাড়ি চলে যায়, শহরটা পুরোটা ঘুরে দেখা হয়নি তাই সব জায়গা ভালো চেনেও না।
পরের দিন থেকে তিতিয়ানাকে যেন একটু বেশি করে লক্ষ্য করতে থাকে। শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিটা প্রশ্নোত্তর - কথোপকথন মন দিয়ে শোনে সে।
বন্ধুত্বের প্রথম হাতটা বাড়িয়ে দিলো তিতিয়ানাই ।
'' কেমন লাগছে ক্লাস। আমি শুনলাম তুমি নতুন এসেছো শহরে । তা এখানে কেন এলে ? তোমাদের ওখানে কি কলেজ নেই ?''
তারপর কথা শুরু হলো দুই সহপাঠীর।
এই ভাবে দিন যায়, মাস যায় ,বছর যায়। মাঝে বাড়ি আসে তিয়ানশুক। বাবা- মায়ের খুব আনন্দ আজ। এতদিন বাদে ছেলে বাড়ি এসেছে। গ্রামের সব্বাই এলো দেখা করতে। গাঁওবুড়ো মোড়ল মশাই এর মাঝে রাখলেন একখানি প্রস্তাব।
'' কেমন হয় তিয়ানশুক যদি এখানকার স্কুলে পড়ানোর ভার নেয়। এখানকার ছেলে-মেয়েরা তো কম মেধাবী নয়। কিন্তু এত দূরের গ্রামে কোনো শিক্ষক পড়াতে আসতে চায় না। কি বলেন হেডস্যার ?''
গাওঁবুড়ো মোড়লমশাই হেডস্যারের সমর্থন চাইলেন।
'' কিন্তু, তিয়ানশুক কি আসতে চাইবে? সে এখন অনেক বড় শহরে থাকে। সেখানকার জলহাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।'' বললেন হেডস্যার।
তিয়ানশুক রাজি। কোনো আসবে না সে গ্রামে ? এতকাল সে গ্রামে থেকেছে। পিনকুট কি সুন্দর একটা গ্রাম। কি সুন্দর নদী । নদীতে খেলা করছে মাছ। কি সুন্দর খেত। হাওয়ায় দুলছে ধানের শিস। কি সুন্দর পিনকুটের আকাশ। আর এখানকার মানুষজন ! কত আপনার। সে কি শহরে থাকতে গেছে নাকি ? সে তো গেছে পড়তে। পড়া শেষ হলেই তো চলে আসবে গ্রামে। এতো ঠিক করেই রেখেছে তিয়ানশুক।
কলেজের শেষ পরীক্ষা আজ। ফলাফল বেরোতে দু'মাস দেরি। ফল হাতে পেয়ে তিয়ানশুক যাবে গ্রামে ফিরে । কিন্তু তিতিয়ানা কে ছেড়ে সে থাকবে কি করে?
কলেজের পাশে ছিল একটা ছোট খাবারের দোকান, পড়াশোনার ফাঁকে তিতিয়ানা আর তিয়ানশুক সেখানে বসে করতো পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা। খাবার ভারী চমৎকার সেখানকার। চা, পাউরুটি আর সবজি বা মাংসের স্ট্রু - ভারী পছন্দের খাবার তাদের।
খাবারের দোকানে বসে প্রথম কথা বললো তিয়ানশুকই ,
''তিতিয়ানা, আমাদের কলেজ তো শেষ হয়ে গেলো, এবার তো চলে যেতে হবে আমাকে । আমার বুড়ো মা -বাবা যে অপেক্ষা করছে। তাদের সঙ্গে থাকতে হবে এবার আমাকে। ''
অনেক্ষন ধরে মন দিয়ে খাবার খাচ্ছিলো তিতিয়ানা। এবার মুখ তুলে চাইলো সে।
'' রোজগারের কথা কি ভাবলে? ''
'' সংসারে সবজি বাগান থেকে আসে সবজি, আর শস্য খেত থেকে আসে শস্যের পসরা। আর নদীতে আছে মাছ। তাই দিয়ে চলে যায় আমাদের সারা বছর। গ্রামের স্কুলে পড়াবো ঠিক করেছি আমি । আমাদের স্কুলে ভালো শিক্ষক নেই জানো তিতিয়ানা। ওখানে কত বাচ্চা আছে, কত ভালো ছাত্র- ছাত্রী তারা। নতুন নতুন কত কিছু জানতে চায় ওরা। আমি শেখাতে চাই ওদের অনেককিছু। '' থামলো তিয়ানশুক।
'' এই যে এত পড়াশুনা করলে, শুধু কি গ্রামে থাকার জন্যই ? এর বাইরে তো আরো বড় দুনিয়া আছে। সেটা কি একবার দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার? ''
'' ইচ্ছে তো করে,'' একটু থমকালো তিয়ানশুক ,'' কিন্তু মা-বাবা, হেডমাস্টার মশাই, গাঁওবুড়ো মোড়ল আর গ্রামের সবাইকে যে কথা দিয়েছি পড়াশোনা শেষ হলেই ফায়ার যাবো আমি গ্রামে, নেবো সেখান কার স্কুলের দায়িত্ত্ব।''
'' আমার মনে হয় সেখানে গিয়ে দায়িত্ত্ব নেওয়ার আগে একবার পুরো দুনিয়াটাকে ঘুরে দেখি চলো। আচ্ছা, একটা কাজ করা যাক, আজকে আমার সঙ্গে এক জায়গায় চলো বরং। ''
তিয়ানশুক কিছু উত্তর দিলো না, রাজি হয়ে গেলো যেতে। খাওয়ার পর তারা চললো।
রাজধানী থেকে অনেকটাই দূরে, আরো একটা শহর। নাম, ধরা যাক লিংলিয়ান। একটু আলাদা রাজধানী - শহর থেকে। কেমন যেন পুরোনো পুরোনো শহর। চকচকে-ঝকঝকে নয়, এখানকার মানুষগুলো কেমন পুরোনো হয়ে থাকতে চায়। নতুনের সঙ্গে যেন মহা আড়ি তাদের। সেখানকারই একটা পুরোনো বাড়ির সামনে তারা দাঁড়ালো গিয়ে। তিতিয়ানা সামনে দরজা খুলে দিলো একটা চাবি লাগিয়ে, তারপর তিয়ানশুককে নিয়ে তিতিয়ানা চলে গেলো সেই বাড়ির ভিতর।
একটা ছোট ঘরের ভিতর ঢুকে এলো তারা, বইভর্তি ঘর সেটা। মেঝে থেকে উপরের ছাদ পর্যন্ত তাক সারি সারি ; আর তাকে ভর্তি করা আছে বই, বই আর বই। সামনে একটা টেবিল আর চেয়ার, কাঠের তৈরী । আর বসে আছে একজন চেয়ারে; অসাধারণ সুপুরুষ একজন মানুষ । টিকোলো নাক, সুন্দর টানা টানা চোখ মুখ,বুদ্ধিদিপ্ত চাহনি।
'' এসো তিয়ানশুক, তুমি আসবে জানতাম, তিতিয়ানা বলেছে তোমার কথা। ''
মানুষটির গমগমে, গভীর গলার আওয়াজ। তিয়ানশুক চেয়ে রইল।
'' বসো তিয়ানশুক, একটু শরবত খাও, ফলের শরবত, আমার বাগানের ফল। '' কাউকে নির্দেশ দিল মানুষটি তিনটে শরবত দিয়ে যাওয়ার।
'' আপনার ফলের বাগান ? আমাদের ফলের বাগান আছে। গ্রামে, আমাদের পিনকুট গ্রাম। বাবা করেন পরিচর্যা। ''
'' বাহ্, তাই নাকি ? ভালো ভালো। ''
এতো বই চোখের সামনে, তিয়ানশুক দেখতে চাইছিলো হাতে নিয়ে , নেড়ে -চেড়ে। মানুষটি বুঝতে পারল তার মনের কথা। স্মিত হাস্যে দিলো অনুমতি।
তিয়ানশুক মনের সুখে দেখছে বই ।
'' তারপর, তিয়ানশুক, কলেজ তো শেষ হলো। এরপর কি ভাবলে? কি করবে ? ''
'' গ্রামে ফিরে যাবো। গ্রামে আছে স্কুল। পড়াবো সেখানে। সেখানে আছে অনেক ছাত্র-ছাত্রী। মেধাবী তারা। কিন্তু শিক্ষক নেই সেখানে।'' রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকে মুখ তুলে তিয়ানশুক দিলো জবাব।
'' বাহ্, এতো খুব ভালো। ''
'' ভালো? বাহ্ রে, এত পড়াশোনা হলো , দুনিয়াটাকে দেখবে না ঘুরে? একবার গ্রামে ফিরে গেলে আর কি পারবে আসতে শহরে ?'' তিতিয়ানার কথায় অধৈর্য।
হাত তুলে শান্ত করল মানুষটি। '' তুমি ভালো আছো তিয়ানশুক ?''
অবাক তিয়ানশুক। এ কেমন কথা ! সে থাকবে না কেন ভালো ? ভালো না থাকার ঘটেনি কোনো কারণ ? ভালোই তো আছে সে। খুবই ভালো আছে।
'' আমি জানি তোমার পিনকুট গ্রামে নেই কোনো সমস্যা। সবাই থাকে সেখানে মিলে মিশে। সবাই সবার আনন্দে থাকে, সবাই সবার দুঃখ করে ভাগ। সেখানে আছে খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস , ছলছল নদী জল। কিন্তু এর বাইরেও তো আছে একটা দুনিয়া। তার কথা কি কোনোদিন , কখনও ভেবেছো তিয়ানশুক ?''
এর বাইরের দুনিয়া ? পড়েছে বটে তিয়ানশুক। কিন্তু ভাবেনি তো ? পরীক্ষার জন্য পড়েছে , নিজের জানার জন্য পড়েছে সেই দুনিয়ার খবর। কিন্তু ভাবেনি তো? ভাবতে হবে নাকি ? ভাবা দরকার কি ?
তিয়ানশুক কে দেখালো কিছুটা চিন্তিত।
'' এই বই গুলো পড়েছো ? '' মানুষটি চেয়ার থেকে দাঁড়িয়েছেন উঠে। গেছেন এগিয়ে সামনের একটা বইয়ের তাকের দিকে ।
'' এই দেখো এই বই গুলো সব, এই খানেই লেখা আছে নানা দুনিয়ার কথা। কেমন করে থাকবে মানুষ সেখানে, কিভাবে করবে দেশের উন্নতি, কি করে গড়ে তুলবে উন্নত শহর-উন্নত সমাজ। গ্রামের মানুষের মুখেই বা হাসি ফোটাবে কি করে, ''
'' তোমার কি মনে হয় আমরা সবাই খেয়ে পরে বেঁচে আছি মানে কি আমরা সবাই ভালো আছি ? ''
একটু থেমে যোগ করল মানুষটি।
''দেশের মানুষের উন্নতি হবে !সে আবার কেমন ? দেশের মানুষ তো উন্নতি করছে , ফসল ফলাচ্ছে, শহর তৈরী করছে, কত উঁচু উঁচু বাড়িঘর তৈরী করছে। কত রকমের জিনিসপত্র, সবই তো আধুনিক। শহরে কত আধুনিক জিনিসপত্রের দোকান-বাজার। সব আলো ঝলমলে। মানুষ চাঁদে যাচ্ছে। অন্য্ গ্রহে যাবারও তোড়জোড় করছে। এটাই তো উন্নতি। আর ভালো নেই আমরা? সবাই তো সুখেই আছি ? এত রোশনাই শহরে, আর গ্রামেও তো ভালোই আছে সবাই। ''
আস্তে আস্তে বলল তিয়ানশুক।
'' না, ভালো নেই আমরা। দেশের সব মানুষ যখন শিক্ষা, চাকরিতে পাবে সমান অধিকার , গ্রামের কৃষক যখন ফসল ফলিয়ে দাম পাবে সঠিক , নারীদের উপর যখন হবে না কোনো অত্যাচার, দেশের রাজা যখন-তখন পাইক পেয়াদা পাঠিয়ে তুলে নিয়ে যাবে না সমালোচকদের, রাজা যখন শুনবে সবার কথা, দেশে হবে না কোনো অশান্তি তখনি হবে ভালো থাকা। ''
তিয়ানশুকের বিস্ময় আর কাটে না।
'' আচ্ছা তুমি কি দেশের কোনো খবরই রাখো না?'' তিতিয়ানা যেন বিরক্ত একটু।
তিয়ানশুকের ঘোর আর কাটতে চায় না। তাহলে কি এবার থেকে ভাবতে হবে অন্য্ ভাবে ? জীবনটাকে নিয়ে কি ভাবা যাবে না আগের মতো ?
'' শোনো তিয়ানশুক, আমি তোমাদের মতো যোদ্ধা চাই। রাজা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ''
'' যুদ্ধ ? কোথায় যুদ্ধ ?''
'' এ যে সে যুদ্ধ নয়, এ হলো অধিকারের যুদ্ধ। এ হলো ভালো থাকার যুদ্ধ। এই দেশ, এই জিয়ানগংগা দেশ যে আমাদের সবার। তুমি নিশ্চই এটা জানো যে এই দেশে আছে বহু ভাষার মানুষ, বহু ধর্মের মানুষ। তারা সবাই যে এদেশের বাসিন্দা। এই দেশে থাকতে চায় সবাই তারা । সব ছাত্র-ছাত্রী করতে চায় পড়াশোনা। সবার জন্য শিক্ষা। গরিব বড়লোক সবার জন্য শিক্ষা। কর্মঠ মানুষ পেতে চায় উপযুক্ত কাজ। চায় ভালো পারিশ্রমিক। চাই কলকারখানা। চাই বাণিজ্য। চাই উপযুক্ত পরিবেশ কৃষির। চাই সবার জন্য শান্তির পরিবেশ। ভাবো, তিয়ানশুক ভাবো। এগুলো নিয়ে ভাবো এবার। ''
মানুষটির মুখ এখন কঠোর - কঠিন। দৃপ্ত কথা বলবার ভঙ্গিমাটি।
তিয়ানশুকের মাথায় এখন ঘোর বিস্ময়।
'' এই দেশের রাজা করছে সবার উপর অত্যাচার। মুষ্টিমেয় ধনী মানুষজন আছে তার সঙ্গে। সাধারণ মানুষের কথা বলার উপর চাপাচ্ছে বিধিনিষেধ। বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশ বন্ধ করেছে দরিদ্র এবং মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের। বন্ধ হচ্ছে কলকারখানা। শ্রমিকরা হারাচ্ছে কাজ। কৃষকরা পাচ্ছে না উপযুক্ত দাম ফসলের।''
তিয়ানশুক ভাববে, নিশ্চয়ই ভাববে।
'' বাবা, রাজধানীতে ফিরতে চাই আমি আবার। ''
'' সেকি কেন ? কিন্তু কথা তো দিয়েছিলে পড়াশুনার শেষে ধরবে স্কুলের হাল ? এখানে নেই কোনো ভালো শিক্ষক । তুমি ছাড়া নয় কেউ ভরসাযোগ্য। কিন্তু এ তুমি কি কথা বলছো তিয়ানশুক? ''
যোগ দিলেন স্কুলের হেডমাস্টার। কোনো কথাই শুনলো না তিয়ানশুক। চলল নিজের মতো। কারো বোঝানো কোনো কাজে এলো না। মায়ের কান্নাকাটি এলো না কোনো কাজে।
পরীক্ষা শেষে একবার গিয়েছে তিয়ানসুক গ্রামে, জানিয়ে এসেছে নিজের সিদ্ধান্ত।
তিয়ানশুক চলে এলো শহরে। তিতিয়ানার সঙ্গে চললো সেই মানুষটির দলে যোগ দিতে। দলের নাম মাঙ্গোগিরি। তাদের নেতা শিশিমারা। তাদের প্রথম কার্যক্রম হলো রাজা কে রাজপ্রাসাদে ঘেরাও করা। রাজা খুব ই দুর্নীতি গ্রস্ত।
শুরু হলো এক অভিযান। রাজা কে অপসারণের অভিযান।
তিয়ানশুক আর তিতিয়ানার জীবন শুরু হলো, এই জীবন সংগ্রামের জীবন। সেই দলে ছিল আরো অনেকে, আরো অনেক সৈনিক। সবাই লড়াই করছিল স্বাধীনতার জন্য।
'' তারপর ?'' প্রশ্ন করে তুয়াংলিং।
'' সেই লড়াই চলছে দিদিভাই। ''
'' এখনো শেষ হয়নি? কবে হবে শেষ?''
''জানি না দিদিভাই। জানি না।'' দূরের পাহাড়ের দিকে তাকালো বুড়ো তামলিং।
কবে যুদ্ধ শেষ হবে জানে না বুড়ো তামলিং। জানে না পিনকুট গ্রামের কেউ। কবে ভাই-বোন তুয়াংলিং আর শিনবোনা দশ বছর ধরে তাদের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া বাবা-মা তিয়ানশুক আর তিতিয়ানার দেখা পাবে জানে না কেউ। জানে না
--------------------------------------------------------------
পুতুলের বাক্স
বড় নিঃস্তব্ধ এই সন্ধ্যা। শীতকালীন সন্ধ্যা, বড় দীর্ঘ। সূর্য তাহার সকল প্রকার প্রাতঃকালীন কর্ম সমাপন করিয়া নিদ্রা যাইতেছে। এই আসমানও যেন ক্লান্ত এবং অবসন্ন বোধ করিতেছে। বিস্তীর্ন চরাচর ব্যাপী কেহ যেন গাঢ় বিষাদের রং ছড়াইয়া দিয়াছে । পক্ষীকুল নিজদিগের বাসায় ফিরিয়া যাইতে ব্যস্ত। ছোট বালক বালিকা পক্ষিগণ অপেক্ষায় আছে তাহাদের মাতাপিতার। খাদ্য লইয়া আসিবে তাহারা । ভারি এক ভুরিভোজ হইবে ! সমস্ত দপ্তর- কল কারখানা ছুটি হইয়া গিয়াছে। পুরুষেরা আপিসের ব্যাগ গুছাইয়া নিজ গৃহ অভিমুখে রওয়ানা দিয়াছে। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েগুলিকে গৃহিনী তাগাদা দিয়া পড়িতে বসাইয়াছে। আজ জলখাবারে লুচি হইয়াছে। কর্তার আবার লুচি ফুলকো না হইলে মন ভরে না। গৃহিণীর গা ধুইয়া একখানা ধোয়া সুতির কাপড় পরিয়া জলখাবার গুছাইয়া রাখিতেছে। আর তাহারই মধ্যে বারংবার জানালার দিকে দৃষ্টি চলিয়া যাইতেছে। খোকা-খুকুরা অপেক্ষা করিতেছে দম দেওয়া পুতুল কি একটা লবেনজুসের।
শ্যামাপ্রসাদ নৌকার ছইয়ের ভিতরে শুইয়া এইসবই আকাশপাতাল ভাবিতেছিল। নৌকা স্বরূপগঞ্জের পাশ দিয়ে আসিবার সময় ভাঙ্গা মেলার দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকাইয়াছিল সে। মেলা শেষ হইয়া গিয়াছে বোধকরি । অদ্যই শেষ রজনী। বিক্রেতারা ক্লান্ত বোধ করিতেছে, কিন্তু বুঝিবা বিক্রি খুব ভালো হইয়াছে। ''আজ বিক্রিবাটা কেমন ?'' বুঝিবা হাঁক পারিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছে একে অপরকে। যাহাকিছু বিক্রি হয় নাই তাহা বুঝিবা গাঁঠরিতে বেঁধে নিতেছে তাহারা ।
জিয়াগঞ্জ পৌছাইতে আরো আধঘন্টা।
মেলায় আসিতে সুলতাও বড় ভালোবাসে। শ্যামাপ্রসাদকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিতেই হয়। না হইলেই গোঁসা করে যে বড়!শ্যামাপ্রসাদের মা যদিও ছেলের এই অসৈরণ কান্ড একেবারেই পছন্দ করিতেন না। মেলায় আসিলেই কেমন যেন ছেলে মানুষ হইয়া যায় সুলতা। এই দোকানে যায় , সেই জিনিসটা নাড়াইয়া - চারাইয়া, ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখে। খাবারের দোকানগুলিতে ছুটিয়া ছুটিয়া যায়, কেনা চাই খাবার, সবকিছু বড় আগ্রহভরে দেখে, আশ আর মেটে না, যেন সব জিনিস একদিনেই কিনিয়া লইতে হইবে।
পুব পাড়ার রাস্তা দিয়া একটুক্ষন ঘুরপথ হয়, আর এই পথ দিয়াই মেলায় যায় শ্যামাপ্রসাদ আর সুলতা। এই পথ বড় নির্জন, তেমন কেউ আসে না এই পথে, পথের চারপাশে গাছের ছায়া, অদূরে জঙ্গল। সুলতার কোমল হাতখানি শ্যামাপ্রসাদ নিজ বলিষ্ঠ হস্তে চাপিয়া ধরে। সুলতা একটু লজ্জার ভান করিয়া দূরে সরিয়া যায়। বিকেলের পড়ন্ত গোধূলিতে সুলতার আরক্ত মুখখানিকে ভালো করিয়া দেখিবার অভিপ্রায় শ্যামাপ্রসাদ কাছে টানিয়া লয়।
'' আহ, কি করচ, ছাড়ো ছাড়ো, কেউ দেকে ফেলবে যে, কি যে করো, আমার মাথা খাও, ছাড়ো বলচি '' - শ্যামাপ্রসাদ সহাস্যে ছাড়িয়া দেয় কিন্তু হাতখানি ধরিয়া রাখে ।
মেলা বসে চক্রবর্তী পাড়ার শেষ প্রান্তে। কত দোকানি আসিয়া দোকান লাগায়। গাঁয়ের সবাই যায় মেলা দেখিতে। পুরুষেরা তাদের বাড়ির মেয়ে- বৌদিগের সঙ্গে করিয়া লইয়া যায়। কত রকম লোকজন, কত তাদের কথাবার্তা, সবাই দোকান দেখিতেছে, ছেলেপুলেরা পুতুলনাচ অথবা তামাশার আসরে ভিড় জমাইতেছে, মেয়ে- বৌয়েরা হাঁড়ি -কুরি দর করিতেছে।
সুলতা চুড়ি পছন্দ করিতেছে। লাল,নীল রং-বেরংয়ের কত রকমারি চুড়ি। চুড়ির পরে পুঁতির মালা। কাঁচের চুড়ি বড় ভালোবাসে সুলতা। মেলায় আসিলে চুড়ি সে কিনিয়াই ছাড়ে। সুলতার একখানি বাক্স আছে, তাহার মধ্যে থাকে হরেক রকমের কাঁচের চুড়ি, ছোট ছোট কত রকমের খেলনা পুতুল , আরো কত কি । মেলা হইতে খরিদ করা সমস্ত মহার্ঘ সামগ্রী সে তার পুতুলের বাক্সে রাখিয়া দেয়। সুলতা অনেক জিনিস জমাইয়াছে । মধ্যে মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ তাহাকে জাপানি পুতুল কি কাঠের ঘোড়া আনিয়া দেয়। তাহাও জমা পরে সেই পুতুলের বাক্সে। বড় প্রিয় সেই বাক্স খানি ।
সুলতা দরিদ্র ঘরের মেয়ে, বিবাহের সময় প্রচুর দানসামগ্রী নিয়া আসে নাই সে। পিতৃগৃহ হইতে তেমন সোনার গহনাও দেয় নাই। সোনার গহনা যা দিয়াছিল তা শ্যামাপ্রসাদের গৃহ হইতেই। সোনার গহনার প্রতি কোনোদিনই তাহার তেমন মন ছিল না।
খাবারও নিতে হইল অনেক রকমের, রকমারি মিষ্টান্ন, নোনতা খাবারই কতরকমের। ফিরিবার পথ ওই পুব পাড়ার ঘুরপথ, সন্ধ্যা তখন গাঢ় হইয়া আসিয়াছে। বাড়ি ফিরিয়া একটু খানি জিলিপি ভাঙিয়া প্রায় জোর করিয়া সুলতার মুখে পুড়িয়ে দিল। আস্তে আস্তে চিবাইতেছে সুলতা,লাজুক মুখখানা দেখিতে বড়োই আমোদ বোধ হয় শ্যামাপ্রসাদের ।
খাইতে বড় ভালোবাসে সে। পিতৃগৃহে ভালো করিয়া খাইতে পাইতো না। তাই সুখাদ্য দেখিলে লোভ সামলাইতে পারে না । একবার এই করিতে গিয়া এক বিষম কান্ড ঘটিয়ে গিয়াছিল । রন্ধনের দায়িত্ত্ব শ্যামাপ্রসাদের মাতা সামলাইতেন। একদিন সকালে শ্যামাপ্রসাদ স্নান করিয়া খাইতে বসিয়াছে, আপিস যাইবে। হঠাৎ মায়ের চিৎকার '' ও আবাগীর বেটি, খেতে পাস্ না, ভিখিরি কোথাকার, নোলা তোমার এত, তাই না?..বাড়ির কারো খাওয়া হলো না আর উনি খেয়ে ফেলেছেন'' , শ্যামাপ্রসাদ দৌড়াইল। রান্নাঘরে একপাশে জড়সড় হইয়া দাঁড়াইয়া আছে সুলতা। মাথা নিচু। রান্না করিতে করিতে শ্যামাপ্রসাদের মাতা কি এক কর্মোপলক্ষ্যে একটুখানি রান্নাঘরের বাহিরে গিয়াছেন, তরকারিতে নুন-মিষ্টান্ন অনুপাত ঠিক আছে কি না তা পরীক্ষা করিতে বলিয়া গিয়াছেন বধূকে । তাহা করিতে গিয়া ডিমের ডালনার অর্ধেকের বেশি খাইয়া ফেলিয়াছে সে ! বড় অপরাধীর মতো দাঁড়াইয়া ছিল। শ্যামাপ্রসাদের বড় কষ্ট হইয়াছিল। সরিয়ে আসিয়া ছিল সে স্থান হইতে। না হয় একটু খাইয়া ফেলিয়াছে। তা বলিয়া এই ভাবে বলিতে হইবে! সমস্তদিন সুলতা উপবাসে রহিল। সেই ঘটনার পর হইতে সুলতা বড় কম খাইত আরম্ভ করিল। যদিও শ্যামাপ্রসাদের খাওয়া আগেই হইয়া যাইতো তবুও মাকে লুকাইয়া রান্নাঘরে উঁকি মারিয়া একবার দেখিয়া লইতো সুলতা খাইয়াছে কি না। পূর্বের তুলনায় পাতে কম ভাত তরকারি লইতো। শ্যামাপ্রসাদ অনেক বার বলার চেষ্টা করিয়াছে ,'' এত কম খাও কোনো তুমি? এরকম করলে শরীর টিকবে ? '' সুলতা কোনো উত্তর করিত না।
এরপরেও যে সুলতা নম্র, ভদ্র, সলজ্জ, সর্বত্যাগিনী ও শশুরকূলের সেবিকা হইয়া উঠিতে পারিয়াছি, একথা হলফ করিয়া বলা চলে না। অবশ্যম্ভাবী অনাবশ্যক এবং অহেতুক কতগুলি কান্ড ঘটাইয়া ফেলিত। পাশের বাড়ির হেমদা পিসিমা জ্বরে বেহুঁশ হইয়া পড়িয়া আছে আজ দুইদিন হইল। তিনকূলে কেহ নাই তার। সকালবেলা প্রতিবেশিনীরা খোঁজ করিয়াছে বটে, তবে সারারাত্র জাগিয়া সেবা করিবার দায়িত্ত খানা সুলতাই তুলিয়া লইল। এমনি কত উদাহরণ।
বৈঠার ছপাক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাইতেছে না। জলের স্রোত একজায়গায় আসিয়া ঘূর্ণি পাকাইতেছে, সেইদিকে শ্যামাপ্রসাদ গভীরভাবে তাকাইয়াছিল।
বিভিন্ন কর্মকান্ড যখন বিরক্তির কারণ হইয়া উঠিতেছে, তখন সুলতা একখানা কান্ড ঘটাইয়া বসাইল। সোনার গহনা শ্যামাপ্রসাদের বাড়ি হইতে বিবাহের সময় দেওয়া হইয়াছিল প্রায় পঁচিশ ভরির মতো। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণ বসত সুলতার সোনার গহনার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। সে ভালোবাসিত কাঁচের চুড়ি, পুঁতির মালা এইসব। এই কথা আগেই উল্লেখ হইয়াছে।
পাশের বাড়ির নিত্যানন্দ কাকার মেয়ে বুঁচি একদিন তাহার মায়ের সহিত শ্যামাপ্রসাদের গৃহে আসিল। গৃহে কোনো ছোট শিশু নাই। বুঁচি আসিয়াই সুলতার সঙ্গী হইল, উহারা নিজেদের মধ্যে আমোদ করিতে লাগিল। বুঁচি একখানা খেলার বাক্স সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিয়াছিল । কিন্তু বাড়ি যাইবার সময় বাধিল গোল,বুঁচি কাঁদিতে লাগিল, সে নাকি তার খেলার বাক্সখানা খুঁজিয়া পাইতেছে না। বিস্তর খোঁজাখুঁজি হইল, কিন্তু পাওয়া গেল না। বুঁচি আর তার মা বাড়ি চলিয়া গেল।
গোল সম্পূর্ণ রূপে বাঁধার বোধহয় আরো কিছু বাকি ছিল, এর দুইদিন পর শ্যামাপ্রসাদ সেদিন গৃহে বিশ্রাম করিতেছে। হঠাৎ চিৎকার '' চোর কোথাকার, চোর একটা, মর তুই '' শ্যামাপ্রসাদ ছুটিয়া গিয়াছিল । উঠানে সুলতা পড়িয়া আছে, শাশুড়ি মাতা চুলের মুঠি ধরিয়া পিঠে ঘা কতক দিতেছে। বেশবাস বিস্রস্ত। পাশে দাঁড়াইয়া আছে বুঁচি আর তার মা , বুঁচির মা বলিয়া চলিতেছে '' বাবা গো বাবা, সোনা নয় দানা নয় তোমার বৌ এর পুতুলের বাক্স চুরি করার ইচ্ছে গেলো? এতো বাপের জন্মে দেখিনি বাপু, তা হ্যাঁ গো তোমাদের বৌয়ের মাতার ব্যামো-ট্যামো আচে নাকি?'' কাপড়ে মুখ চাপিয়া বুঁচির মা হাসিতে লাগিল। সেখানে আরো কয়েকজন প্রতিবেশিনী উপস্থিত ছিল, তাহারাও সেই হাসিতে যোগ দিল।
সেদিনের পর সুলতা নিজের পুতুলের বাক্সখানা আর খুলিয়াও দেখে নাই । শ্যামাপ্রসাদকে এরপরই কলিকাতা চলিয়া আসিতে হয় কর্মসূত্রে।
নৌকা ঘাটে আসিয়া ঠেকিল। সম্বিৎ ফিরিলো মাঝির কথায় '' দা'বাবু এসে পরিচি , '' শ্যামাপ্রসাদ নামিয়ে আসিল। ক্ৰোশখানেক পথ এখনও । শ্যামাপ্রসাদ পথ চলিতে আরম্ভ করিল। শান্ত চতুর্দিক, কোনো কোলাহল নাই।
একদিন রাত্রে, ঘুম ভাঙিয়া যাওয়াতে শ্যামাপ্রসাদ দেখিল সুলতা জানালার কাছে বসিয়া আপনমনে কি যেন ভাবিতেছে। শ্যামাপ্রসাদ কাছে যাইতেই সুলতা বলিয়া উঠিল '' এই দেখো এই আমার টুকরি পুতুল, আর এই আমার গনসা পুতুল, আর এই হলো গে খুকি পুতুল, এ ভারী অভিমানী পুতুল।'' পুতুলগুলির গায়ে পরম মমতায় হাত বুলাইতে লাগিল। খোলা বাক্সের ভিতরে ছিল অসংখ্য রং-বেরংয়ের চুড়ি, পুঁতির মালা, জরি, ফিতে, কাঠের খেলনা, মাটির খেলনা। সুলতার অমূল্য সম্পদ।
ধুতির কোঁচাটা ভালো করিয়া জড়াইয়া লইলো। বাড়ির পথটা বড়োই কর্দমাক্ত। চতুর্দিক বড় বেশি শান্ত যেন । পথ যেন আর শেষ হইতেই চায় না। রাত্রি আন্দাজ নয়টা বাজে। দরজায় করাঘাতের সঙ্গে সঙ্গে মা কবাট খুলিয়া দিল। '' ও বাবা, শ্যামা, এত দেরি করলি কেন বাবা, সেই থেকে ঘরবার করচি। আহা গো, বাছার আমার মুকখানা একেবারে শুকিয়ে গেচে। হাত মুকখানা ধুয়ে আয় দেকি বাবা , আমি খাবার এনে দিচ্চি । '' মা বাতের ব্যথা লইয়াই ভিতর বাড়ি চলিয়া গেল।
শ্যামাপ্রসাদ নিজ ঘরটিতে প্রবেশ করিল। কমলমনি আয়নার সামনে দাঁড়াইয়াছিল, '' তোমার এত দেরি হলো যে, আমি তো ভাবছি এবার তুমি এলেই না। শোনো কাল কিন্তু গঞ্জে যাবো, এখানকার স্যাকরা ভালো ডিজাইনের গয়না করতে পারবে না। ...কি গো কিছু বলছো না যে। কি হলো আবার কোথায় যাচ্ছ ?''
শ্যামাপ্রসাদ আলমারির কোণ হইতে একটা বাক্স লইয়া ছাদে যাইবার সিঁড়ির দিকে চলিল।
সুলতা আর নাই। পুকুরে নাইতে গিয়া আর ফিরিয়া আসে নাই। কমলমণি শ্যামাপ্রসাদের দ্বিতীয় পক্ষ, আড়তদার রমাকান্ত বাবুর স্কুল ফাইনাল পাশ করা মেয়ে ।
-----------------------------------------------------------------------------
নিরঞ্জনবাবু
নিরঞ্জনবাবু রোজ এসে এই পার্কের বেঞ্চিতে বসেন। সকাল সাতটা আর আর বিকেল পাঁচটা। সময় দুটো একদম ঠিক করা আছে। কোথায় যেন একটা টিয়া পাখি ডাকছে না ? নিরঞ্জন বাবু ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখবার চেষ্টা করলেন। ছোট বেলায় গ্রামের বাড়িতে যেতেন, তখন টিয়ার ঝাঁক দেখতে পেতেন, কি সুন্দর ! এক জায়গায় অনেকগুলো পাখি বসে থাকত, হাততালি দিয়ে তাদের উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করতেন। খুব মজা পেতেন তাতে , এখন একবার দেখবেন নাকি ? ওই তো ওই জামরুল গাছের ডালটায় অনেকগুলো টিয়া বসে ডাকছে। এই বয়েসে এই রকম ছেলে মানুষি মানায় নাকি ? কিন্তু কেই বা দেখতে যাচ্ছে এখানে , সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ওই তো ওপাড়ার জগাদা মর্নিওয়াক করতে এসেছে। কানে একটা হেডফোন নিয়ে নিজের মনে জোরে জোরে হাঁটছে। পাশের বেঞ্চে একটা ছেলে - আর একটা মেয়ে বসে...এত সকালে এখানে কি করছে এরা ? দেখে তো মনে হয় স্কুলে পড়ে। এত গুজগুজ ফুসফুস করে কি এত গল্প করছে ? অবাক নিরঞ্জন বাবু, একি রে! এই বয়েসে প্রেম ? তাও আবার এতো সকালে ফাঁকা পার্কে বসে ? স্কুল নেই এদের ? নাকি কোচিং যাবার নাম করে এখানে এসে বসে আছে ? অদ্ভুত সব! নিরঞ্জন বাবু কিঞ্চিৎ বিরক্ত, তাও নিজেকে সামলালেন। তবে ভারী ভালো লাগলো এই জুটিকে দেখে। নিরঞ্জনবাবু নিজের মনেই একটু হাসলেন। চায়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিলেন। কলেজ জীবনের কথা হালকা করে একটু মনে এলো। সুচরিতা... দারুন সুন্দরী ও বিদুষী ছাত্রী ছিল । কথা বলতে চাইতেন। কিন্তু পারতেন কই ? কত কথা চাপা রয়ে গেল মনের মধ্যে । বলা হয় নি। তাদের কালে এত মেলামেশা করা যেত নাকি ? তার উপরে সদাই তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা। একটা হালকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অফিসেও ছিল একজন...সংঘমিত্রা। ছোটখাটো , খুব সুন্দরী না হলেও আলগার উপর একটা চটক ছিল। না, ওসব আর ভাববেন না। তার থেকে বরং , এই প্রকৃতিকে একটু উপভোগ করা যাক। এই যে পার্কটা , এটার ভিতর একটা পুকুর আছে, কি সুন্দর টলটলে জল ছিল আগে , কি অবস্থা করে রেখেছে ছেলেপুলেরা। একটু পরিষ্কার তো করতে পারে । নোংরা একদম সহ্য করতে পারেন না নিরঞ্জন বাবু। অথচ...না এটাও বা ভেবে কি করবেন। নিজের হাতে কি কিছু থাকে ? চায়ের দিকে মন দিলেন নিরঞ্জনবাবু। চায়ের নেশা বরাবর। দিনের মধ্যে দশ- বারোবার চা তো চাই তার। তপতির দায়িত্ব ছিল সেটা। সে অবশ্য নিজের হাতেই বানিয়ে দিয়েছে বরাবর। তপতি, নিরঞ্জনবাবুর স্ত্রী নম্র, ভদ্রস্বভাব। আবার নিরঞ্জনবাবু কোথায় হারিয়ে গেলেন।
বাবার পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করেছিলেন নিরঞ্জনবাবু। মায়ের কাছে কাছে থেকে সংসারের কাজ করত তপতি। অফিসে যাবার আগেও দেখতেন তপতি কাজ করছে, অফিস থেকে ফিরেও দেখতেন তপতি কাজ করছে। চিরদিনের পিটপিটে নিরঞ্জনবাবুর খুব একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না স্ত্রীর সঙ্গে। তপতীকে মা কিছু না কিছু কাজ দিয়ে আটকে দিতেন। রাত্রে দেখা হ'ত খালি। কিন্তু তাতেও কোনো অসুবিধা হ'তো না নিরঞ্জনবাবুর। মা -বাবাও চাইতেন না বৌয়ের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা হো'ক ছেলের। ওদের কথা মান্য করতে পেরে একরকম স্বস্তি বোধ করতেন যেন। কোথায় আছেন এখন বাবা-মা ? কোন জগতে কে জানে ? তপতিকে খানিক অবহেলায় করেছেন বলতে গেলে? ধুর অবহেলা আবার কি ? খাওয়া-পরা তো দিয়েছেন, এর বেশি আবার কি ? এখন আবার এসব কথা ভাবতে বসেছেন কেন? নিজের মনেই বিরক্ত হলেন নিরঞ্জনবাবু।
আর একটু চা পেলে মন্দ হতো না , চায়ের তেষ্টাটা জেগে উঠেছে নিরঞ্জনবাবুর মনে। কিন্তু সামনের চায়ের দোকান গুলো এখনো তো খোলেই নি। ধুস , আবার একটু প্রকৃতিতে মন বসাতে চেষ্টা করলেন। আরো কিছু পাখি বসেছে , পাখিতে মন দিতে পারছেন কি ? আজ কেন বার বার তপতির কথা মনে পরে যাচ্ছে ? তপতি ছিল বড় সাধারণ। বড় সাধারণ ঘরোয়া মেয়ে সে। বড় সাধারণ চাহিদা। এই একটু বরের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়া। রবিবারের দুপুরবেলা পাঁঠার মাংস খাওয়ানো বরকে। আর পুজোর সময় বরের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। ঘর সাজানোতেও ছিল খুব সাধারণের ছাপ। বিয়েতে পাওয়া একটা সাধারণ খাট। একটা আলমারি। একটা আলনা। সব কিরকম সাধারণ।
ওদিকে সুচরিতা কি অসাধারণ! অফিতে আসতেন সিল্কের শাড়ি পরে। কি সুন্দর আকাশি রঙের একটা অসম সিল্কের শাড়ি পরে এসেছিলেন তিনি। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। মুগ্ধতা এড়ায়নি সুচরিতার। চোখে একটা প্রশ্রয়ের ছাপ দেখেছিলেন নাকি ? আবার একটা শ্বাস ফেললেন। কি হবে আর এসব ভেবে। কিন্তু তারই বা কি দোষ ? কোনোদিনই ভালো লাগে নি এতো সাধারণ তপতিকে। কোথাও নিয়ে যেতেন না তপতিকে। সাধারণ দাম্পত্য সান্নিধ্যও এড়িয়ে যেতেন তিনি। তপতি নিরলস পরিশ্রম করত সংসারে। কোনো অভিযোগ জানায়নি।
কিন্তু এখন কি করবেন নিরঞ্জনবাবু ? সকাল বেলার সময় টোও শেষ হতে চলল। ফিরে যেতে হবে বাড়ি। হ্যাঁ, বাড়ি। এই পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর তপতি তাঁকে নিয়ে সংসার বেঁধেছে ওই পার্কের পুকুরে। ওই তো তাঁকে নিতে উঠে আসছে !
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন