সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রমোশন / অনুবাদ গল্প সিরিজ - গল্প - ১/ Adopted from R.K Narayan's Story Forty Five A Month


R.K Narayan এর গল্প Forty Five A Month এর ছায়া অবলম্বনে 

প্রমোশন

অস্মিতার ক্লাসে আর মন টিকছে না, স্কুল এ যেটা ওর সবথেকে পছন্দের - সেই ছবি আঁকা- সেটা অব্দি করতে ওর আজ মন চাইছে না। কারণ আজ যে বাবা ওকে প্রমিস করেছে মুভি দেখাতে  নিয়ে যাবে। কি মজা, বাবার সঙ্গে মুভি দেখতে যাবো- সব বন্ধুদের বলা হয়ে গেছে যে আজ ওরা ঘুরতে যাচ্ছে । ঘোরা বলে ঘোরা, আজ বাবা প্রমিস করেছে মুভি দেখাবে, আর আঁকার বই কিনে দেবে, নতুন রং পেন্সিল কিনে দেবে, আর ওর প্রিয় খাবার-যেটা ও খেতে খুউবব ভালোবাসে -পিজ্জা, সেটাও খাওয়াবে। কিন্তু কখন যে ছুটি হবে আর দৌড়ে বাড়ি যাবে আর রেডি হবে; সকাল থেকেই যেন আর তর সইছে না অস্মিতার।
অবশ্য বললেও দৌড়ে যাওয়া যায় না স্কুল থেকে বাড়ি- অস্মিতার বাড়িটা বেশ দূরে, মা ওকে নিয়ে যায় । ছুটি হতেই মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে পরে অস্মিতা। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আর রিক্সায় যেতে যেতে অজস্র কথার তুবড়ি ছোটায়। আজ কখন বেরোনো হবে, কোন মল এ যাওয়া হবে,কোন জামাটাই বা পরবে আজ ও- এগুলো নিয়েই চলতে থাকে বিস্তর জল্পনা।
বাবার ফিরতে ৬টা বাজবে, বেরোনো হবে তার পরেই- অস্মিতার মা দিতি মেয়েকে নিরস্ত করে এই বলে। কাল শনিবার তাই আজ বাড়িতে দেরিতে ফিরলেও চলবে, কারণ পরেরদিন স্কুল যাবার তারা নেই। বাড়ি ফিরেও কি শান্তি আছে দিতির-
''এখন কটা বাজে মা?''-
''কেন?''
''ছটা বাজতে আর কত দেরি আছে?''
''এখনো দেরি আছে, সোনাই।''- দিতি কাজ করতে করতে উত্তর দেয়।
''কত দেরি, মা''- অস্মিতার গলায় অধ্যৈর্যের সুর।
''এখন সবে ২তো বাজে, আরো ৪ ঘন্টা, এবার আর কথা নয় অনেক বেলা হয়েছে এবার খেয়ে নাও মুখ বন্ধ করে।''- মায়ের কথায় অস্মিতা খাবার টেবিলে বসে।
দিতি মেয়েকে ঘুম পড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু অস্মিতার চোখে ঘুম কোথায়? দিতি ঘুমিয়ে পড়েছে, অস্মিতা বারান্দায় কিছুক্ষন দাঁড়ালো, কিছুক্ষন লাল রংয়ের টেডি তাকে নিয়ে খেললো, কিন্তু বাবা কখন আসবে.....
দিতি উঠে পড়েছে, এখন অস্মিতা র আবদার সামলাচ্ছে, কোন জামাটা পরে যাবে সেটা নিয়ে চললো মা আর মেয়ের বিস্তর যুক্তি আর তর্ক। অবশেষে জিত হলো অস্মিতার, সবথেকে পছন্দের সাদা আর গোলাপি রঙের জামাটা পরবে ঠিক হলো।
এটা নয় যে অস্মিতা বেড়াতে যায় না, কিন্তু এই ৬ মাস এ বাবার সঙ্গে কোথাও বেরোতে পারেনি সে,- অস্মিতা র বাবা দেবদত্ত একজন সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ৬ মাস আগেই সিনিয়র ম্যানেজারের পোস্টে প্রমোশন পেয়েছে। পরিবার কে সময় দেবার ইচ্ছা থাকলেও সময় বের করতে পারেন না। অস্মিতা কোথায় ঘুরতে গেলে তার মায়ের সঙ্গেই যায়, দিতি অবশ্য মেনে নিয়েছে দেবদত্তের এই সময় না দিতে পারা টাকে - কি করবে, দিতি বুঝতে পারে দেবদত্তের এই অসহায়তাকে, কিছু কিছু সময় অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হয়, তাই দিতি যতটা পারে সময় দেয় মেয়েটাকে।
এখন সময় বিকেল ৫ টা। অস্মিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে বাবার অপেক্ষায়। নিচে অস্মিতার বন্ধুরা খেলতে ডাকছে,কিন্তু ও আজ যাবে না। আজ যে বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাবার দিন।
ওদিকে দেবদত্ত নিজের কেবিন এ বসে একটা প্রেজেন্টেশন  বানাচ্ছে, ল্যাপটপ এ মগ্ন। টেবিলে এর এক পাশে দিতি আর অস্মিতার ছবি। বয় এসে লাঞ্চটা দিয়ে গেলো, দেবদত্ত প্লেট এর দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থিম গেলো, চোখ পড়ল ছবিটার দিকে- অস্মিতা আর দিতির ছবি, ছোট্ট অস্মিতা কত্ত বড় হয়ে গে'ল, দেখতে দেখতে পাঁচ এ পড়ল। কতটুকু সময় দিতে পারে ও ছোট্ট সোনাইকে, আজ অবশ্য প্রমিস করেছে নিয়ে যাবে মুভি দেখতে।
এখন বিকেল ৫টা, একটু পরে শুরু হবে টীম মিটিং। দেবদত্ত কে থাকতেই হবে, আধ ঘন্টা থেকে বেরিয়ে যাবে আজ, তারপর বাড়ি পৌঁছতে সাড়ে ছটা। তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে বেড়োবে দিতি আর অস্মিতা কে নিয়ে।
কিন্তু মিটিং শুরু হতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো, আর দেবদত্ত কেও থাকতে হলো পুরো মিটিং  টায়। বেরোতে যাচ্ছে তখনি ডাক পড়ল, বস এর ঘর-এ । মি. সেনশর্মা - রিজিওনাল ম্যানেজার এই কোম্পানির।
''এস দেবদত্ত, ব'স, শোনো বেশি সময় নষ্ট করছি না, লাস্ট তিনমাসের সেলস রিপোর্ট আশা করি দেখেছো...ডিসকাস ও করেছো আশা করছি তোমার টিম এর সঙ্গে...সোওও, দেবদত্ত কি ভাবছো তুমি? ...আমাদের চারটে ক্লায়েন্ট হাতছাড়া হয়ে গেছে...কিছু ভাবো দেবদত্ত, এবং তাড়াতাড়ি ভাবো...
কোম্পানির রেপুটেশন...''
দেবদত্তর মাথায় আর কিছু মাথায় ঢুকছিল না, এবার একটু ব্রেক দরকার। সারাদিন অফিস, মিটিং, ক্লায়েন্ট, প্রেজেন্টেশন ...আজ এইসবের থেকে একটু ছুটি চাইছে দেবদত্ত, ছয় মাস হয়ে গেলো আজ কের দিনটা অন্ততঃ...
''দেবদত্ত, দেবদত্ত''...মি সেনশর্মার ডাকে চটক ভাঙে দেবদত্তর। ''আমরা মনে হয় কিছু একটা ডিসকাস করছি......প্লিজ কন্সেন্ট্রেট, শোনো, আমি জানি তোমার উপর খুব স্ট্রেস পরবে কিন্তু কোম্পানি তোমাকে একটা অফার দিতে চায়- আমরা হয়তো একটা নতুন ক্লায়েন্ট পেতে চলেছি, কিছুই ফাইনাল নয় অবশ্য- এবং কোম্পানি চাইছে এই ক্লায়েন্টকে তুমি আর তোমার টিম হ্যান্ডেল কর - আমি অবশ্য তোমার নামটা রেকমেন্ড করেছি...সোওও, এক্সিস্টিং ক্লায়েন্ট-এর সঙ্গে এই প্রজেক্টও তুমি আর তোমার টিম হ্যান্ডেল করবে।'' ''...আর, ও হ্যাঁ, দেবদত্ত আমার একটা আর্জেন্ট কাজ আছে, সেটা করেই তোমাকে নতুন প্রজেক্ট টা ব্রিফ করছি...এটা সাকসেসফুল  হলে...নেক্সট ইয়ার প্রমোশন উইথ গুড হাইক..... আমি দেখবো, চিন্তা করো না।''
চোখ নাচিয়ে সেনশর্মা কেবিন থেকে বেরোলেন। দেবদত্ত একটু চুপ করে বসে থাকলো, এখন ঘড়িতে বাজে ৮টা। দেবদত্ত ফিরে গেলো নিজের কেবিন এ। সোনাইটা কি এখনো বসে আছে...অপেক্ষা করছে বাবার...দেবদত্ত নিজের ল্যাপটপ টা আবার খুলল।
অস্মিতা বসে ছিল অনেক্ষন বারান্দায়, সন্ধ্যায় দুধটাও খাওয়াতে পারেনি দিতি ওকে, দিতি কাছাকাছি ঘুরিয়ে আনতে চেয়েছিল - কিন্তু অস্মিতা খুব গুম মেরে ছিল-যায়নি , ৯ টা নাগাদ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে দিতি বেশ জোর করেই।
দেবদত্তের ফিরতে সাড়ে এগারোটা হয়ে গেলো, দিতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। দেবদত্তর গাড়ির আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দিল, '' যখন জানোই নিয়ে যেতে পারবে না তখন কেনই বা মিথ্যা কথা গুলো ব'লো মেয়েটাকে, এবার থেকে এসব প্রমিস আর করো না, ও একটা ছোট্ট বাচ্ছা এটা এটলিস্ট মনে রেখো, সারা সন্ধ্যেটা বারান্দায় বসে কাটিয়েছে,"'...
দেবদত্ত অস্মিতার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো,.....সোনাইটা ঘুমিয়ে কাদা, সাদা-গোলাপি রঙের জামাটা ছাড়েনি মেয়েটা, দেবদত্ত নিচু স্বরে বলতে থাকে
'' সামনে আমার প্রমোশন রে সোনাই , এরপর নিয়ে যাবো তোকে, অনেকদিনের দিনের জন্য... বাইরে কোথাও...ডিজনিল্যান্ড...খুব মজা হবে দেখিস...''
অস্মিতা ঘুমের ঘোরে লাল টেডি টাকে ভালো করে জড়িয়ে ধরলো, তখনও জলের একটা দাগ লেগে আছে অস্মিতার চোখের কোণে।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস বা মগ্নচৈতন্য / What is Stream of Consciousness?

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস ? সাহিত্য ধারায় এটি এক রীতি, বলতে গেলে লেখনীর এক ধরণ। সাহিত্যের আলোচনায়  কিংবা সমালোচনায় 'স্ট্রিম অফ কনসাসনেস'- ‘Stream of Consciousness’  বা মগ্নচৈতন্য শুধুমাত্র এক শব্দ নয়, এ এক অনন্য, এক স্বতন্ত্র জঁর  ।  মগ্নচৈতন্যের   স্রোত সাহিত্যসৃষ্টির এক অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন ধারা,  যা কিনা  বিংশ শতাব্দীর কিছু বিখ্যাত লেখক   নিযুক্ত এক স্বতন্ত্র লেখন রীতি। নিজেদের লেখনীতে কিছু ঘটনা পরম্পরাকে  বর্ণনা করতে ব্যবহার করেছিলেন তারা ।  কিন্তু '  মগ্নচৈতন্য '  কী?  কেনই বা  এটি একটি 'ধারা' বা ' জঁর' ?  কিছু  পরিচিতি দিলাম বটে শুরুতে কয়েকটি শব্দকে আশ্রয় করে, তবে  বিস্তারিত আলোচনা  এগোবে আস্তে আস্তে।  এই আপাত সাধারণ এবং একইসঙ্গে ব্যাপকভাবে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা যুক্ত , সাহিত্যিক টার্মটির ধারণা  পরিষ্কার করতে সহায়তা করতে পারে হয়ত এই  আলোচনা ।   Image Courtesy: Steve Jhonson:pixels.com/free image প্রকৃতপক্ষে...

একটি প্রেমের গল্প : অমৃতা প্রীতম এবং সাহির লুধিয়ানভি / The love story of Amrita Pritam and Sahir Ludhianvi

প্রেমের গল্প। প্রেম ভাঙার গল্প। পাত্র-পাত্রী সাহির লুধিয়ানভি এবং অমৃতা প্রীতম। দিকপাল দুই সাহিত্যিক। কেমন ছিল সেই সম্পর্ক ? ''আমি তো জানতাম সাহির, তোমার কোনোদিনই আমার প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো দায় ছিল না । কি যেন বলে আজকাল ! ও হ্যাঁ , কমিটমেন্ট ফোবিয়া।  ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবে কি না সেই দ্বিধাতেই তো রয়ে গেলে। কেন  যেন মনে হয় আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা  সেই গভীরতর  অতলান্ত  স্পর্শ করে নি কোনোদিন। ছুঁয়ে দেখেনি সেই ভালোবাসার তীব্র টানকে। আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবেসেছ  ? যতটা আমি তোমাকে বেসেছি।  "ম্যায়নে টুট  কে প্যায়ার কিয়া তুম সে / ক্যায়া  তুমনে ভী উতনা কিয়া মুঝ সে?'' অমৃতা প্রীতম এবং সাহির লুধিয়ানভি : Image Courtesy : Indian Express  ' ''মোহাব্বত কি পরখ  কা  ইয়েহি  তো রাস্তা  হ্যায় / তেরি  তালাশ মে নিকলু, তুঝে  না  পায়ু  ম্যায় '' । অমৃতা ভালোবাসা খুঁজেছেন, সেই আকুল করা ভালোবাসা,  হৃদয় তন্ত্রীতে সেই তীব্র...

ভারতে পিকনিকের খাবারের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস / The Diverse History Of Picnic Food In India

  ভারতে পিকনিকের খাবারের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস / The Diverse History Of Picnic Food In India ভারতে  কিরকম ভাবে হয় পিকনিক। কিভাবেই বা হতো ব্রিটিশ আমলের পিকনিক? মহাভারতের যুগেও কি হতো পিকনিক?  পিকনিক: Image Courtesy: Getty Image  মহাভারত থেকে ব্রিটিশ রাজ - বাড়ির বাইরে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া , না, না কোনো রেস্তোরাঁর কথা বলছি না, বলছি পিকনিকের (picnic) কথা,  বাংলায় চড়ুইভাতি বলি যাকে। ছোটবেলার পিকনিকের স্মৃতি রাজত্ব করছে এখনও,আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু যুগের ঐতিহ্য এই চড়ুইভাতি এখনও টিকে আছে বহু বদলের পরেও।  শুধুমাত্র মেনু পরিবর্তিত হয়েছে,পরিবর্তিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর চরিত্র, ভৌগলিক দূরত্বের সাথে আলাদা হয়েছে বিভিন্ন  চড়ুইভাতির রকম - সকম, খাবারের মেনুর। আশি কিংবা নব্বই দশকের প্রকাশিত হওয়া কোনো গল্পের সিরিজে, সিরিয়ালে, উপন্যাসে, কিংবা রম রম করে  হল গুলোতে চলা সিনেমাতে  পক্ষে মেয়েদের রঙিন মাসিক পত্রিকাতে  পিকনিকের উল্লেখ , ছবি থাকতই থাকত। বড় বেলায় দেখে ছোটবেলার পিকনিকের ছবি। কিন্তু  একটা জিনিস নিয়ে দুঃখ আমার বরাবরই থেকে...