সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রুট - কলকাতা থেকে লন্ডন / The World’s Longest Bus Route- From London To Kolkata

পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রুট - কলকাতা থেকে লন্ডন / The World’s Longest Bus Route- From London To Kolkata



কলকাতা থেকে লন্ডনে যাবেন? বাসে চেপে ? ঠিক এইরকমই এক পরিকল্পনা করা হয়েছিল একবার...

লন্ডন-কলকাতা-কলকাতা - লন্ডন, বাস সার্ভিস তাও  আবার লাক্সারি  বাস সার্ভিস। চমকে  উঠলেন  নাকি ? তা চমক লাগানো কথা বটে ! খাস কলকাতা থেকে বাস নিয়ে যাবে কিনা সুদূর লন্ডন ! হ্যাঁ, সত্যি।  বাস বটে একখানা। নাম তার এলবার্ট।  খাসা ট্যুর প্ল্যান হয়েছিল। কি দুঃখ হচ্ছে? যেতে পারবেন না তাইএত দুঃখ করার কিচ্ছু  নেই, সেই বাসে  এখনও চড়তে পারেন আপনি। কি বলছেন, তাই আবার হয় নাকি ? খুব  হয়। কিন্তু একটু টাইম মেশিনে চড়ে বসতে হবে যে

পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রুট - কলকাতা থেকে লন্ডন / The World’s Longest Bus Route- From London To Kolkata
Image  Courtesy: reddit.com 


১৯৬০  সালে  কলকাতা  থেকে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন যাওয়ার জন্য একটি বাস সার্ভিস। ডবল ডেকার সমস্ত রকমের লাক্সারি সুবিধাযুক্ত বাস। এলবার্ট ট্যুর।  বিশ্বের দীর্ঘতম বাস রুটে  কলকাতা থেকে লন্ডন যাবার জন্য ভাড়ার পরিমান ধার্য হয়েছিল ১৪৫ পাউন্ড - ভারতীয় টাকায় ১৩,৫১৮ - এক পিঠের ভাড়া।  যা নিঃসন্দেহে সেই সময় এক বিশাল অঙ্ক।  এই বাস-ভ্রমণের কিছু ছবি এখন  সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে - নেটিজেনরা সাক্ষী হতে চাইছে সেই মজাদার টাইম -ট্রাভেলের। 

সেন্ট্রাল ওয়েস্টার্ন ডেইলি-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, অ্যান্ডি স্টুয়ার্ট নামে এক ব্রিটিশ ভ্রমণকারী  ১৯৬৮ সালে  সিডনি থেকে ভারত হয়ে লন্ডন যাওয়ার জন্য এই বাসটি কিনেছিলেন। ১৯৬৮ সালের ৮ই অক্টোবর, তিনি সিডনির মার্টিন প্লেস থেকে ১৩ সহযাত্রী নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। প্রায় ১৬,০০০ কিলোমিটার পথ  যাত্রা করতে হবে তাদের।   ১৭ই  ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ সালেলন্ডনে পৌঁছেছিলেন অ্যান্ডি  সময় লেগেছিল ১৩২ দিন। বাসটি ইংল্যান্ড থেকে সিডনি গিয়েছিল। পথে অতিক্রম করেছিল বিভিন্ন দেশ।  বেলজিয়াম, পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রিয়া, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ডমালয়েশিয়া  সিঙ্গাপুর। ভারতে জুড়েছিল, দিল্লি, আগ্রা, এলাহাবাদ, বেনারস এবং শেষ পর্যন্ত কলকাতায় শেষ হয়েছিল এলবার্টের যাত্রা।  

টাইমটেবিল 


কলকাতা, লন্ডন এবং সিডনি জুড়ে এই যাত্রাপথ অ্যালবার্টের জন্য তৈরী হয়েছিল বছরব্যাপী টাইম টেবিল। প্রতিবেদন অনুসারে, ,, ,, এবং   নম্বরযুক্ত ট্রিপগুলি সরাসরি সিডনি ট্যুর।১২ থেকে ১৫ নম্বরযুক্ত ট্যুরগুলি লন্ডন  এবং কলকাতার মধ্যে। 

World's Longest Bus Route From Kolkata To London
Image  Courtesy : twitter.com 



বিলাসবহুল  এলবার্ট ট্যুরস 


বিলাসিতা  কাকে বলে একবার যে এলবার্টে না চড়েছে সে বুঝতেও পারবে না বাসের নীচের ডেকে একটি রিডিং এবং ডাইনিং লাউঞ্জ- যাত্রীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো পড়াশোনার কাজ করতে পারবে, ডাইনিং যাত্রীরা বেশ গল্প করতে করতে খাবার খাবে।  উপরের ডেকের সামনে ছিল একটা  অবসেরভেশন লাউঞ্জ। এছাড়া ছিল, সমস্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ একটি সম্পূর্ণ সজ্জিত রান্নাঘর।  যাত্রীদের জন্য আমোদ-প্রমোদেরও যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল। সন্ধ্যের পার্টিগুলি যাতে রঙ্গীন সংগীতমুখর  হয়ে ওঠা তার জন্য ছিল যথেষ্ট পরিমান রেডিও আর টেপরেকর্ডার।  ব্যবস্থা ছিল অভ্যন্তরীন  ফ্যান হিটারের , শীতের হাত থেকে যাত্রীদের উষ্ণ রাখত। এগুলি ছাড়াও সমস্ত  যাত্রীদের জন্য আলাদা আলাদা বাঙ্ক ছিল, ঘুমানোর এবং বিশ্রাম নেবার জন্য। বাসের আভ্যন্তরীন সজ্জা ছিল দেখবার মতো উজ্জ্বল রঙের পর্দা আর পর্দা এবং কার্পেট মুড়ে দেওয়া হয়েছিল বাসের ভিতর। এই সমস্ত বিলাসবহুল ব্যবস্থা সহ, এলবার্ট  সত্যি ছিল আলবার্ট  ‘home away from home’.

World's Longest Bus Route From Kolkata To London
Image  Courtesy: twitter.com 

এলবার্টের পথে ট্যুরিস্ট  স্পট




ইংল্যান্ড থেকে সিডনি যাওয়ার পথে এলবার্ট পেরিয়ে যাবে  অসাধারণ সব দর্শনীয় স্থান বা টুরিস্ট স্পট- দেখতে পাবেন  ইস্তাম্বুলের গোল্ডেন হর্ন, দিল্লির ময়ূর সিংহাসন, আগ্রার তাজমহল, বেনারসের  গঙ্গা, ক্যাস্পিয়ান সমুদ্র উপকূল, নীল দানিয়ুব, ড্রাকোনিয়ান পাস, রাইন ভ্যালি, খাইবার পাস এবং কাবুল-জর্জ। না, এখানেই শেষ নয়, আরো আছে, শর্তসাপেক্ষে  ফ্রি শপিং এর সুযোগ। জমিয়ে কেনাকাটা। কোথায় ? আরে  কোথায় নয় বলুন, দিল্লি, কাবুল, ইস্তানবুল, তেহরান, ভিয়েনা, সালজবার্গ এবং আরও অনেক জায়গায় ফ্রি শপিংয়ের তালিকায় যুক্ত ছিল।.

World's Longest Bus Route From Kolkata To London
Image Courtesy: twitter.com 

World's Longest Bus Route From Kolkata To London
Image Courtesy : facebook.com 


এলবার্ট  কলকাতা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রায় ১৫ টি ট্যুর করবে এমনই   কথা ছিল, ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ৪ টি ট্যুর করবে ঠিক ছিল এমনটাও। প্রায় ১৫০ টি সীমানা পেরোতে হ'ত এলবার্টকে এই পুরো ট্যুরটা করতে গেলে। অবশ্য সীমানাগুলি পেরোতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কাগজপত্রেরও খুব একটা দরকার পরতো না। যে দেশগুলির উল্লেখ আছে এখানে, সেগুলি আসলে ''বন্ধুরাষ্ট্র'' এর ট্যাগ অর্জন করেছিল আগেই।  

আচ্ছা, একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি। এই বাসের সবটুকু গল্প সত্যি।  মানে বাসের অস্তিত্ত্ব সত্যি ছিল। এই সাংঘাতিক ভালো ট্যুর প্ল্যানটাও মজুত ছিল। কিন্তু যেটা হয়নি, সেটা হলো এই বাসযাত্রা বাস্তবে কখনও ঘটেনি। খুব অবাক হলেন তো ?  ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে এমনই নানা গল্প।  সেই গল্পের ঘনঘটা মাঝে মাঝে আমাদের বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। l

--------------------------------------------------------------------------------
 

দুলালের তালমিছরি: এক নস্টালজিয়া / Dulaler Taalmichri: The Nostalgia





দুলালের তালমিছরি: এক নস্টালজিয়া / Dulaler Taalmichri: The Nostalgia
তালমিছরির লেবেল : Image Courtesy: Wikimedia Common 


তালমিছরির একটি ব্র্যান্ড কীভাবে বাংলাকে তথা বাংলার পরিবারকে মুগ্ধ করে রেখেছে ! কিভাবেই বা এর ভালোবাসায় ডুবিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর ! তারই না বলা গল্প আজকে শোনাব। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, আমরা বাঙালিরা, সর্দি কাশিতে আরাম ও ঠান্ডায় নিরাময়ের জন্য আইকনিক হলুদ তালমিছরির বোতলটিকেই আপন করে নিয়েছি। 



এমন কিছু জিনিস, যা ছাড়া কলকাতার কোনও বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়িটাকে ঠিক বাড়ি বলে মনেই হয় না। যেমন বোরোলিন অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমের একটি সবুজ টিউব, গুপ্ত প্রেস বা বেণীমাধব শীলের একটি বিশ্বস্ত ফুল পঞ্জিকা, মুখরোচক চানাচুরের উজ্জ্বল লাল প্যাকেট এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ, একটি দুলালের তালমিছরির বোতল। স্ফটিকের মতো পালমাইরা পাম এসএপি তাল মিছরির (crystallising inspissated palmyra palm sap) মধ্যে আছে শরীর ঠান্ডা রাখার ঔষধিযুক্ত গুণাবলী বা কুলিং প্রপার্টিজ (cooling properties), ঠাণ্ডা এবং সর্দি - কাশি দূরে রাখারও টোটকার জন্য পরিচিত - প্রতিটি বাঙালি বাড়িতে অপরিহার্য । বেশিরভাগ বাঙালির কাছে, আজও, তাল মিছরি দুলালের নামের সমার্থক। 



নব্বই-এর দশকে কলকাতায় বেড়ে ওঠা ছোটরা সবাই দুলালের তালমিছরির একটি বয়াম বাড়িতে দেখতে অভ্যস্ত ছিল, ক্যানারি-হলুদ (canary-yellow) রঙের বোতল এবং নীল কালির লেবেল সিলুয়েটেড পালমিরা পাম গাছের (silhouetted palmyra palm trees) ছবি দিয়ে ছাপানো, রান্নাঘরের জালের মিটসেফ এ থাকত। এর পাশে অনিবার্যভাবে থাকত পলিক্রোল(polycrol), অ্যাকোয়া টাইকোটিস (aqua ptychotis) এবং ইসাবগুলের শিশি - বাঙালি বিখ্যাত বদহজম মোকাবেলার সমস্ত প্রধান হাতিয়ার! গ্রীষ্মকালে, প্রতিদিন সকালে প্রথমে মৌরি মিছরির জল - পেট আর শরীর ঠান্ডা রাখার একটি বিশ্বস্ত উপাদান ছিল। ছিল অপরিহার্য অঙ্গ। 



এক মুঠো মৌরি এবং তালমিছরির কয়েকটি দানা রাতে এক গ্লাস জলে ভিজিয়ে রাখা হত। পরের দিন সকালে, মিশ্রনটি বাড়ির বাচ্চাদের খাওয়ানো হত। অনেক বাড়ির বাচ্চাই মিছরির জল পছন্দ করত সকালে নয়, বিকেলে। তাল মিছরি দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি জল - যেটার জন্য গরমের দিনে স্কুল থেকে ফেরার পর হাপিত্যেশ করে বসে থাকত তারা। এক ঢোক মিষ্টি মিষ্টি মিছরির জল পলকে সতেজ করে তুলত।  



যখন তখন মিছরি চুরি করে খাওয়ার অভিজ্ঞতার কিন্তু কোনো তুলনা হয় না, মিছরি যেন আরও সুস্বাদু লাগত সেইসময়, রোমাঞ্চকর ছিল সব তুত ভাই বোনদের সঙ্গে সেই চুরি করা তালমিছরি খাওয়া। বড়রা তাকাচ্ছেন না এমন সুযোগে এক মুঠো তাল মিছরি মুখে পুরে দেওয়া! হয়ত কারও চোখে পরে গেল, একবার কি করছিস বলা ছাড়া কিন্তু কেউ অভিযোগ করত না। 



তাল মিছরি কাশি এবং সর্দির চিকিৎসায় সমানভাবে কার্যকর। প্রকৃতপক্ষে, ব্র্যান্ডটি প্রাথমিকভাবে কফ এবং কাশির প্রতিকার হিসাবে তাল মিছরি বাজারে নিয়ে আসে। একটি পুরানো প্রিন্ট বিজ্ঞাপনে একজন মা এবং একটি শিশুর ছবিকে ব্যবহার করা হয়, এবং ক্যাচলাইন করা হয়: সর্দি ও কাশিতে দুলালের তালমিছরি (সর্দি ও কাশির জন্য, দুলালের তালমিছরি)। মহিলারা, বিশেষত বাড়ির বয়স্ক মহিলারা মিছরির জাদুকরী শক্তিতে প্রবল বিশ্বাসী ছিলেন। যখনই সর্দি বা কাশির আভাস পাওয়া যেত, তখন তুলসী পাতা, বাসকপাতা, এবং এক টুকরো তালমিছরি ছিল অব্যর্থ ওষুধ। 



কিন্তু দুলালের তালমিছরি কীভাবে এই কাল্ট স্ট্যাটাস ( cult status) বা মর্যাদা অর্জন করল? এবং কীভাবেই বা এটি আট দশক ধরে প্রায় একচেটিয়া নিজের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, এর জন্মের সময় ফিরে যাওয়া দরকার। 



• ব্র্যান্ড বিল্ডিং (brand building): 



বাংলায়, যেখানে খেজুর গাছ প্রচুর, সেখানে তাল মিছরি ১৯৩০ সালে দুলাল বাজারে আসার অনেক আগে থেকেই বর্তমান ছিল। সুভাষ সমাজদার, তার ১৯৭৫ সালের বই "বানিজ্যে বাঙালি : সেকাল ও একাল", হুগলির চমৎকার পাম সুগার (palm sugar) বা তালমিছরি উৎপাদনের দীর্ঘ লেগাসির কথা লিখেছেন - সেটা গুড় হোক বা স্ফটিক মিছরি। বাবু টি এন মুখার্জির মত উনিশ শতকের লেখকদের মতে, বাংলার খেজুর যেন যথেষ্ট ছিল না তাল মিছরি উৎপাদনের ক্ষেত্রে, সিলন, মাদ্রাজ এবং অন্য জায়গা থেকে প্রচুর পরিমাণে পাম ক্যান্ডিও (palm candy) কলকাতায় আমদানি করা হত। 



দুলালের তালমিছরি যে সময়ে যাত্রা শুরু করে, সে সময় দেশ স্বদেশী আন্দোলনের উন্মাদনায় উত্তাল । বিদেশি পণ্য বয়কটের জন্য মহাত্মা গান্ধীর আহ্বান সারা দেশে অনুরণিত হচ্ছে। বাংলায়, কিছু পারিবারিক মালিকানাধীন স্বদেশী ব্র্যান্ড তৈরির প্রসার ঘটতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। 



এই যখন ব্যবসা বাণিজ্য রাজনীতির মধ্যে ভরেদের আগমন. কলকাতা থেকে খুব বেশি দূরে নয়, বাংলার হুগলি জেলার একটি ছোট শহর রাজবলহাটের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবার ছিল এই ভর পরিবার। এই পরিবার বয়নশিল্প বা টেক্সটাইল (textile) ব্যবসায় প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিল এবং এই সাফল্যের বেশিরভাগ কৃতিত্বের দাবিদার জহরলাল ভর । সুধীর কুমার মিত্র তার "হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গ সমাজ" বইতে রাজবলহাটের উন্নয়নে জহরলাল ভরের অসংখ্য জনহিতকর অবদানের কথা লিখেছেন। মিত্রমশাই উল্লেখ করেছেন, জহরলালই, যিনি চিনির মিছরি বা সুগার ক্যান্ডি (sugar candy) ব্যবসায় উদ্যোগ নিয়েছিলেন, এবং তার ছেলে - দুলাল চন্দ্র ভরের নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। ভর পরিবারই প্রথম যাঁরা সময়ের চাহিদা মেনে সাদা চিনির মিছরির ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং তাতে বৈচিত্র্য আনে। 



দুলাল চন্দ্র, যিনি "তাল মিছরির " ব্যবসা পরিচালনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন, প্রধানত তাঁর প্রচেষ্টাতেই কোম্পানির ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে ট্রেডমার্ক নিবন্ধিত বা রেজিস্ট্রেশন (registration) হয়েছিল, এবং কালে কালে একটি জনপ্রিয় নাম হয়ে ওঠে। নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক নম্বর 3965 টোকেন হিসাবে লেবেলে মুদ্রণ করা হয় এখনও। 



তালমিছরি তৈরি হত তালমিরা তাল গাছের খাঁটি মিষ্টি রস থেকে (pure sweet sap of palmyra palm trees)। বছরের পর বছর ধরে - তালমিছরি বা পাম ক্যান্ডি (palm candy) তৈরির প্রক্রিয়া বেশিরভাগটাই অপরিবর্তিত রয়েছে। খেজুরের রস বের করা হয় মার্চের শেষ থেকে জুনের শুরুর মধ্যে এবং দ্রুত গ্যজানো রোধ করতে "প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়"- “processed almost instantaneously” । সেখান থেকে, সারা বছর উৎপাদনের জন্য কুইকলাইম-যুক্ত মাটির পাত্রে (quicklime-lined clay pots ) স্থানান্তরিত করা হয়। 



এরপর আসে মিছরি তৈরির প্রক্রিয়া। সংরক্ষিত খেজুরের রস, সামান্য চিনি সহ, একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখা হয়, বেশ কিছু সময় পরে তাপমাত্রা হ্রাস করা হয় এবং ট্রেতে ঢেলে দেওয়া হয়, তৈরি হয় তরল খেজুরের গুড় (molten palm jaggery ) । নয় দিন পর, গুড় উপরে এবং নীচে স্ফটিকের মত হয়ে যায়, মাঝখানে তরল অবশিষ্টাংশের একটি স্তর রেখে যায়। এই তরলটি সাবধানে নিষ্কাশন করা হয়, তারপর মিছরি কাটা হয়, রোদে শুকানো হয় এবং অবশেষে প্যাকেটজাত করা হয়। এই কাজ করতে গেলে দরকার হয় নৈপুণ্য, নির্ভুল দক্ষতা, মূলত খাঁটি আর দক্ষ শ্রমিকের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে, নয় থেকে দশ লিটার রসে প্রায় এক কেজি মিছরি পাওয়া যায়। 



তাল মিছরির তৈরির সাফল্যের জন্য এর মধ্যে ব্যবহৃত উপাদানগুলিই দায়ী, কতোটা ভালো গুণমান এর বা কোয়ালিটির (quality) হতে পারে তার উপরেই নির্ভর করছে তালমিছরির ব্যবসায়িক সাফল্য। তবে আরও একটি কারণ রয়েছে, যে কয়েক দশক ধরে এটি তার বিশ্বস্ত গ্রাহক বেস (loyal customer base) হারায়নি। শুরু থেকেই, আয়ুর্বেদিক টোটকা ব্যবহার হতো দুলালের তালমিছরি তৈরিতে, কাশি এবং সর্দির ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে এর অবস্থান চিরকালই মানুষের মনে সদর্থক ছিল। তালমিছরি তৈরীর বিশুদ্ধতার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল বরাবরই। পুরানো বিজ্ঞাপনগুলিতে ভেজালবিহীন দেশীয় রীতিতে তালমিছরি প্রস্তুতির থিম ছিল - এই বিজ্ঞাপনই পুনরাবৃত্ত হয়েছে বারে বারে। আর এটাই ঐতিহ্য-আবদ্ধ সেই বাঙালিদের মধ্যে এর আবেদনকে আরও শক্তিশালী করেছে, যারা বিদেশী ওষুধের উৎস সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা রাখেন, এবং তার নিরাময় সম্পর্কে অনিশ্চিত, বিশেষত সন্দেহ পোষণ করেন। এছাড়াও, ভর পরিবারের প্রভাব এবং আর্থিক শক্তি প্রতিযোগিতায় জয়ডঙ্কা বাজাতে সাহায্য করেছিল। 



বিশ শতকের বাংলায় এই ব্র্যান্ডের স্থান কতটা গুরুত্বপূর্ন তা প্রকাশ পায় যখন বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতারা কিভাবে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন সময়কে পুনর্গঠনের জন্য ব্যবহার করেছেন তার উপর– প্রপ হিসেবে- পরিচালক দিবাকর ব্যানার্জির গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সিতে (detective byomkesh bakshy) ১৯৪০ এর কলকাতা থেকে ১৯৭০ এর দশকে কঙ্কনা সেন শর্মার ডেথ ইন দ্য গঞ্জে ( death in the gunj)।




• ব্র্যান্ড (brand) নিয়ে শরিকি বিবাদ : 



১৯৮৬ সালে আনন্দ বাজার পত্রিকার বিখ্যাত দেশ ম্যাগাজিনে "সোনালী মোড়কে ঢাকা হিরে" শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বাংলার তালমিছরির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা হয়, কিন্তু এতে দুলাল চন্দ্র ভরের কোনো উল্লেখ ছিল না - যার নামানুসারে ব্র্যান্ডটির নামকরণ করা হয়। পরিবর্তে, এটি দুলাল চন্দ্রের ভাই সনাতন ভরকে দুলালের তালমিছরির সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দু বলে ধরে নিয়েছিল। নিবন্ধটির পাশাপাশি একটি বিজ্ঞাপন ছিল যা পাঠকদের প্রতারণামূলক আর বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপণের লেবেলের (lebel) বিষয়ে সতর্ক করে! যা সত্যতার দাবি করে দুলালের তালমিছরির! সম্ভবত বিজ্ঞাপনটি একটি সতর্কবার্তা ছিল, কেবল সস্তা আর নকল থেকে সাবধান এরকম একটা সতর্ক বার্তা। তবে পারিবারিক প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষিতে, সম্ভবত এটিই ছিল ভর পরিবারের মধ্যে ফাটলের মূল যা তাল মিছরি ব্যবসাকে ভাগ করতে শুরু করেছিল। 



এই বর্তমান সময় বসে, কি ধরণের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল এই পরিবারের ভিতরে এবং কারণ কী ছিল তা নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। যদিও এটা স্পষ্ট যে পরিবারের মধ্যে ফাটলের কারণে ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৮৫ সালে, দুই ভাই ব্র্যান্ড নাম নিয়ে আদালতে মুখোমুখি হন, সোমনাথ চ্যাটার্জি, যিনি পরে লোকসভার স্পিকার হন, দুলাল চন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। ভাইদের ব্র্যান্ডের স্বার্থে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সম্পর্কে ফাটল ধরে ছিল সাংঘাতিক ভাবে, অমীমাংসিত থেকে যায় কেস এবং ভাইয়েরাও আলাদা হয়ে যায়। 


প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দুলাল চন্দ্রের নাম প্রস্তুতকারক হিসাবে দুলালের তালমিছড়ির লেবেলে ছিল। তাই দুলাল চন্দ্রের নাম এই ব্র্যান্ডের সমার্থক হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে এক ও অভিন্ন। ভাগাভাগির পরে, সর্বসম্মতি ক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে সনাতন ভর আসল ব্র্যান্ড নাম - দুলালের তালমিছরি ব্যবহার করতে পারবে এবং সারাজীবনই তা ব্যবহার করবার অধিকার ভোগ করবে, তবে এর নির্মাতা হিসাবে দুলাল চন্দ্র ভরের নাম আর ব্যবহার করতে পারবে না । দুলাল চন্দ্র ভরের তালমিছরি রিব্র্যান্ড (rebrand) করা হয়েছিল, তাঁর স্বাক্ষর এবং ছবি লেবেলে রাখা হয়েছিল। এখনও এই লেগেসিকে (legacy) এগিয়ে নিয়ে চলেছে তাঁর উত্তর পুরুষ। উভয় ব্র্যান্ড - দুলালের তালমিছরি এবং দুলাল চন্দ্র ভরের তালমিছরি - তখন থেকেই বাজারে সহাবস্থান করেছে, প্রতিটি ওয়ান- আপম্যানশিপের (one upmanship) যুদ্ধে এর বৈধতা নিশ্চিত করেছে, একে অন্যের থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু সাধারণ গ্রাহকের জন্য, এটি এখনও দুলাল চন্দ্র ভরের নামই তালমিছরির গল্পের মূল শিকড়ে রয়ে গেছে। তালমিছরির ব্র্যান্ড সংরক্ষণ করে রাখা যেন এক অব্যবহিত ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।  


দুলালের তালমিছরি ব্র্যান্ড বাঙালির মনের মধ্যে গেঁথে গেছে, অতীতের এক নস্টালজিইয়ার টোকেন ( token of nostalgia) হিসেবে , কিংবা বলা ভালো তা যেন হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত ঐতিহ্য । আর এই চলমান বা লিভিং ট্র্যাডিশন (living tradition) বাঙালির পরিবার তদুপরি তার শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আজকের প্রজন্ম হয়তো তাল মিছরির সম্পর্কে একই রকম রোমাঞ্চ অনুভব করবে না, যা গত দশকের প্রজন্ম করত, কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতিতে এর গভীর শিকড় এই ব্র্যান্ডকে প্রাসঙ্গিক রেখেছে আজও। বাঙালিত্বের ছোঁয়া এবং পরিচিতের আরামকে ধরে রেখেছে দুলালের তালমিছরি।









মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস বা মগ্নচৈতন্য / What is Stream of Consciousness?

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস ? সাহিত্য ধারায় এটি এক রীতি, বলতে গেলে লেখনীর এক ধরণ। সাহিত্যের আলোচনায়  কিংবা সমালোচনায় 'স্ট্রিম অফ কনসাসনেস'- ‘Stream of Consciousness’  বা মগ্নচৈতন্য শুধুমাত্র এক শব্দ নয়, এ এক অনন্য, এক স্বতন্ত্র জঁর  ।  মগ্নচৈতন্যের   স্রোত সাহিত্যসৃষ্টির এক অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন ধারা,  যা কিনা  বিংশ শতাব্দীর কিছু বিখ্যাত লেখক   নিযুক্ত এক স্বতন্ত্র লেখন রীতি। নিজেদের লেখনীতে কিছু ঘটনা পরম্পরাকে  বর্ণনা করতে ব্যবহার করেছিলেন তারা ।  কিন্তু '  মগ্নচৈতন্য '  কী?  কেনই বা  এটি একটি 'ধারা' বা ' জঁর' ?  কিছু  পরিচিতি দিলাম বটে শুরুতে কয়েকটি শব্দকে আশ্রয় করে, তবে  বিস্তারিত আলোচনা  এগোবে আস্তে আস্তে।  এই আপাত সাধারণ এবং একইসঙ্গে ব্যাপকভাবে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা যুক্ত , সাহিত্যিক টার্মটির ধারণা  পরিষ্কার করতে সহায়তা করতে পারে হয়ত এই  আলোচনা ।   Image Courtesy: Steve Jhonson:pixels.com/free image প্রকৃতপক্ষে, ' মগ্নচৈতন্য  '   সাহিত্যের  জঁর  হিসাবে একেবারেই শুরু করেনি    তার  জীবন !  তবে ?   অবাক করা তথ্য এই  যে - সম্ভবতঃ এটি ছিল   এ

আমি হয়তো আবার পাগল হয়ে যাবো- ভার্জিনিয়া উলফের আত্মহত্যা-একটি ট্রাজেডি: The Tragic Tale Of Virginia Wolf's Suicide

  সব আত্মহত্যাই কি আসলে একটা পরিকল্পিত খুন, নাকি স্ব-ইচ্ছায় পালিয়ে যাওয়া? না ফুরোনো স্বপ্ন নিয়ে চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে, কিন্তু ভার্জিনিয়া উলফা কেন আত্মহত্যা করে বসলেন? কোন আলো মাখানো জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলেন তিনি !     বসন্তের একটা দিন, হালকা শীত যেন লুকোচুরি খেলছে, যাই-যাই শীত আর গরমে কাবু হবার দিনগুলির মাঝে হালকা বাতাসের শিরশিরানি অনুভব করা যায়।  সকাল বেলার রোদ্দুর ছুঁয়ে যাচ্ছে চতুর্দিক। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত,  ছেলে বুড়ো সবাই বেরিয়েছে প্রাতঃভ্রমনে,  কেউ বা ব্যস্ত সংসারের খুঁটিনাটি দেখভালে, আবার কারো রয়েছে কাজে যাবার তারা। কিন্তু একজনের কাছে যেন এই পুরো পৃথিবীর আর কিছুই ভালো লাগছে না, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে তার,  লেখা হয়ে গেছে একটা নোট। ওসে নদীর দিকে ধীর পায়ে হাঁটছেন তিনি, কোটের পকেটে ভর্তি করেছেন প্রচুর পাথর, এই পথটা বোধহয় একাই  চলতে হয়, না, কেউ নেই সঙ্গে, কেউ নয়। এই পথ দিয়ে শুধু গন্তব্যে চলেছেন তিনি, যে গন্তব্য থেকে আর ফেরা হবে না, কোনোদিনও নয়, কখনও নয়, কারো কাছেই নয়, মনস্থির করে ফেলেছেন তিনি। কেন করলেন তিনি এটা, কেন নিতে হল এমন সিদ্ধান্ত! ভার্জিনিয়া

বাংলা অণুগল্প- অনুগল্প সিরিজ /Bengali Story

অসীম আর মাধবীলতা অসীম.....এই যে এই দিকে, মাধবীলতা আবার ডাক দিলো,....... হ্যাঁ একদম ঠিক যাচ্ছ,......আমার হাতটা লক্ষ্য করে আস্তে আস্তে এগিয়ে এস, না না ওদিকে নয়.......ওদিকে কাঁটার ঝোপ......গায়ে ফুটে গেলে কেলেঙ্কারির একশেষ.....মাধবীলতা আর ভরসা রাখতে পারলো না, নিজেই এগিয়ে গিয়ে অসীমের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। অসীমের জামাকাপড় ভিজে জবজব করছে। একজায়গায় থামলো তারা, বেশ নির্জন, একটা বাড়ির ভিতরে ঢুকে এল। একটু পুরোনো বাড়ি কিন্তু বসবাসের যোগ্য। মাথাটা মুছে নাও, বেশ ভিজেছ, ঠান্ডা ব'সে গেলে জ্বর আসতে পারে....মাধবীলতা হাতের মুঠো ছেড়ে দিয়ে একটা গামছা এগিয়ে দিল। .অসীম গামছাটা নিয়ে সামনে খোলা জানালার বাইরের পুকুরটার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। মাধবীলতার শাড়ির আঁচলের একটা অংশ একটু দেখা যাচ্ছে। ওদিকটায় বোধহয় কাঁটাঝোপ ছিল. কালকের মধ্যে দুটো লাশ ই ভেসে উঠবে আশা করা যায় । -------------------------------------------- ছ'য়ে ছটাক : অনুগল্প ১. জানালাটার গ্রিলের মধ্যে দিয়ে নিজের চার হাত পা বের করে দিল সে, এবার শেকল দিয়ে বাঁধার কাজ শুরু হবে। ২.আমার পেনের কালিটা ধীরে ধীরে শেষ