সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পৃথিবীর কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড - হত্যাকাণ্ড সিরিজ - পর্ব ২/ Famous Murder Mystries In The World- Part 2

ম্যানসন ফ্যামিলি হত্যাকান্ড/ Manson FamilyGruesome Massacre


  
সাল ১৯৬৯,  গ্রীষ্মকাল , স্থান  আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসের ঝলমলে হলিউড।  ১০০৫০ সিয়েলো ড্রাইভের নির্জন বাংলোটা ব্যক্তিগত পার্টির জন্য এমনিতে বেশ ভালোই  কিন্তু  একইসঙ্গে কিছুটা বিপজ্জনকও । কারণ মূল শহর থেকে তা  কিছুটা দূরে।১৯৬৯ সালের ৯ অগাস্টের  রাত, চারিদিক নিস্তব্ধ, গরম বেশ ভালোই পড়েছিল। হলিউড আর বেভারলি হিলসকে ঘিরে রাখা ক্যানিয়নের  জলের সঙ্গে বাতাসের শব্দের এক অদ্ভুত খেলা চলছিল। হালকা বাতাসে শব্দের প্রতিধ্বনিও হয় বেশ অন্যরকম। বহু দূরে পাথর গড়িয়ে যাবার শব্দকে পাশের ঘরের শব্দ বলে ভ্রম হয়।   মিস্টার সেমুর তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন রাস্তারই পাশের এক বাড়িতে। মাঝরাতের পরে পরেই শুনলেন বন্দুক থেকে গুলির ছোটার মতো শব্দ। বহুদূরের পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া পাথরের শব্দ ভেবে উড়িয়ে দিলেন তা, তলিয়ে গেলেন ঘুমের অতলে। পাশের বাড়িতে কী ভয়ানক কাণ্ড চলছে, তা যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতেন! সোয়া মাইল দূরে ছিল  একটা সামার ক্যাম্প। ৩৫টি বাচ্চা ছিল সেই ক্যাম্পে। সেখানকার কাউন্সেলর আয়ারল্যান্ড শুনেছিলেন এক পুরুষকণ্ঠের চিৎকার, ''No! No! Oh God! Please No''  ("না! না! ওহ ঈশ্বর! প্লিজ, না!") একটু  চমকে উঠলেন,  তড়িঘড়ি ছুতে গিয়ে বেনেডিক্ট রোড টহলও  দিয়ে আসলেন, ওটা গিয়ে শেষ হয়েছে সানসেট বুলভার্দে। সন্দেহজনক কিছুই পেলেন না অবশ্য। রবার্ট বালিংটন কিন্তু ঠিক  ব্যাপারটিকে উড়িয়ে দিতে পারলেন না মনের ভুল ভেবে । ওই এলাকারই বাসিন্দা তিনি,  চিৎকারের আওয়াজ পেয়েছিলেন ভোর ৩টার দিকে। সাথে সাথেই ফোন করে দিলেন লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে।যে অফিসারটি অভিযোগ নিয়েছিলেন তিনি হয়তো ভাবতেও পারেন নি কি ভয়ঙ্কর কাহিনীর সাক্ষী হতে চলেছে গোটা দুনিয়া। 
ভোর ৭টায় খবরের কাগজ দিতে আসা ছেলেটি দেখলো, টেলিফোন লাইনের তারটি বেখাপ্পাভাবে বাড়ির ওপর দিয়ে  ঝুলছে। গ্যারেজের ওপরের হলুদ আলোটিও জ্বালানো তখনও । বাড়ির বাসিন্দাদের  আজব খেয়াল ভেবেই হয়তো কাগজটা মেইলবক্সে রেখে বিদায় হলো সে।







সিয়েলো ড্রাইভের বাড়িটি, ইনসেটে বাড়ির বাসিন্দারা; Image Courtesy: crimeonline

বাড়ির প্রতিদিনের কাজের দায়িত্ত্বে ছিল যে সেই  মিসেস চ্যাপম্যানের ঐদিন আসতে আবার একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। ঝকঝকে লন, সুইমিং পুল ওয়ালা বাড়িটি কেমন যেন থম মেরে আছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে কাগজওয়ালা ছেলেটির মতোই  লক্ষ্য করেন টেলিফোন লাইনের তার ঝুলছে , আরও পাশাপাশি বিদ্যুতের লাইনটিও পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। কলিং বেল বাজবে না বুঝতে পারলেন, কি ভেবে সদর দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল সেটা। একটু অবাক হলেন, ড্রাইভওয়েতে একটা অপরিচিত গাড়ি পার্ক করা দেখে। অবশ্য  রাতের দিকে অতিথি  আসাটা  অস্বাভাবিক কিছু না এবাড়িতে। ঘরে ঢুকে প্রথমেই ফোন চেক করলেন তিনি, যা ভেবেছিলেন - ডেড। একটু সামনে এগোতেই তার বুক কেঁপে গেলো, পুরো লিভিং রুম রক্ত মাখা। ভালো করে নজর করলেন, বাইরে বারান্দাতেও রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আর তারপরেই চোখে পড়লো লনে পড়ে থাকা লাশটা। চিৎকার করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এসে চোখ স্থির হয়ে গেলো অপরিচিত সাদা গাড়িটার দিকে, সেখান থেকেও বেরিয়ে আছে একটা লাশের পা ।
বাড়িটা পুলিশে ছেয়ে যেতেই যা একটু সময় নিয়েছিল। একটু পরেই তোলপাড় হয়ে  গেছিল হলিউডে, নৃশংসতায় কেঁপে উঠেছিল গোটা দুনিয়া।
 হলিউডের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত গণহত্যা।  খুন হয়েছিলেন খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক রোমান পোলানস্কির আট মাসের অন্তঃসত্তা স্ত্রী, হলিউড নায়িকা শ্যারন টেট। খুন হওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় ছিলেন হেয়ার স্টাইলিস্ট জে সেবরিং, চিত্রনাট্যকার ওয়াশিচ ফ্রাইকোভস্কি, তার স্ত্রী অ্যাবিগেইল ফোলজার আর ১৮ বছর বয়সী স্টিভেন প্যারেন্ট, যিনি সেই রাতে বাড়ির কেয়ারটেকারের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। ভাগ্যের  জোরে কেয়ারটেকার উইলিয়াম গ্যারেটসন বেঁচে গিয়েছিল। আরেক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক কুইন্সি জোনস, ঐ বাংলোয় রাত কাটানোর কথা ছিল তারও, কিন্তু  সময়ের অভাবে আসা হয়নি তার। রোমান পোলানস্কি সে সময় 'দ্য ডে অফ দ্য ডলফিন (১৯৭৩)' সিনেমার শ্যুটিংয়ের  জন্য লন্ডনে ছিলেন। এ ঘটনায়  বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি, এই সিনেমার  কাজ আর পরে শেষ করতে পারেননি।
সিনেমাজগতে অপঘাতে মৃত্যু কিংবা হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা  খুব বিরল কিছু নয়।  মাফিয়া জগতের সাথে সম্পর্কের কারণে, রাজনৈতিক কারণে, মাদক কিংবা ব্যক্তিগত রেষারেষিতে নির্মমভাবে খুন হয়েছে এরকম ঘটনা আকছার শোনা যায়।  কিন্তু টেট মার্ডারের মোটিভ ছিল সম্পূর্ণ  ভিন্ন।







চার্লস ম্যানসন; Image Courtesy : Biographics.com

এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হয়, পিছিয়ে যেতে হয় যুক্তরাষ্ট্রে ষাট এবং সত্তরের দশকে যখন  তরুণদের মধ্যে হিপ্পি জীবনযাত্রা ক্রমশ দারুণভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছিল। তাদের জীবন দর্শন প্রথাগত সামাজিক ও ব্যবহারিক জীবনযাত্রার  থেকে ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম, পোশাক-আশাকই হোক , কিংবা সঙ্গীত ; সবই জন্ম দিয়েছিল এক বৈপ্লবিক ভাবধারার। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য্ জায়গায়, অবাধ যৌন-স্বাধীনতা আর মাদকাসক্তি, বিশেষ করে সাইকেডেলিক ড্রাগের প্রভাব অনেক তরুণকেই  বিপ্লবের নামে করে তুলল বিপথগামী। ঠিক এরকমই একদল তরুণের, বলা ভালো তরুণীদের, মধ্যমণি ছিল চার্লস ম্যানসন। টিনএজে  সন্তানের  বাবা হওয়া  ম্যানসন ছোটখাট  অপরাধে জেল খেটেছে কয়েকবার। কিন্তু তখনও পর্যন্ত খুনের অভিযোগ ছিল না তার বিরুদ্ধে।
এই ম্যানসনের  ইচ্ছে  ছিল গানে কেরিয়ার তৈরি করা। নিজের একটা ব্যান্ডও তৈরি  করেছিল সে। 'দ্য বিচ বয়েজ' ব্যান্ডের ডেনিস উইলসনের সাথে ভালোরকম  খাতির ছিল তার। ম্যানসন তার গিটারের সুরে মেয়েদের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিল তখনই, কখনো বিটলসের, কখনো বা নিজের লেখা গান গাইত সে, ফলত সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতে শুরু করল, এই বিষয়ে এক আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় তার। কিন্তু মজা হলো, কোনো সঙ্গীতশিল্পীকে  মুগ্ধ করতে পারেনি ম্যানসন। টেরি মেলচার নামের একজন সঙ্গীত পরিচালককে নিজের গান শোনায় সে, কিন্তু সেখান থেকে কোনো আশ্বাস মেলে না গান গাওয়ার। ফলে বিখ্যাত তো দূরে থাক, সাধারণ একজন গায়ক হওয়াও হয়ে ওঠেনি তার।







ম্যানসন ফ্যামিলির একাংশ; Image Courtesy: Los Angels Magazine

সেই সময় ম্যানসন ফ্যামিলি ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে অবশেষে স্পান র‍্যাঞ্চে থাকতে শুরু করে । ম্যানসনের পুরোদমে কাল্ট লিডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ এইসময়েই। কিছু অনুগামী তৈরি হয় তার, কথার জাদুতেই হোক, কিংবা ড্রাগ সরবরাহ করেই হোক নিজের অনুগামীদের পুরোপুরি নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসতে থাকে, একাজে জুড়ি মেলা ভার ছিল তার। তার  অধিকাংশ অনুগামীই ছিল নারী।  অবাধ স্বাধীন জীবনের আশা দেখিয়ে নিজের বিকৃতির  জালে ম্যানসন তাদেরকে জড়িয়েছিল। তারা ম্যানসনের নির্দেশে অবাধে যৌনাচার করত, টাকা-পয়সা তছরুপ থেকে শুরু করে  অবলীলায় যেকোনো অপরাধ ঘটাত। 
 ম্যানসনের ধারণাই  ছিল, খুব শিগগিরই  সাদা এবং কালোদের মধ্যে মহাযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে আর তাতেই নাকি পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যুদ্ধশেষে জয় হবে সাদাদেরই, আর তারপরেই তারা পৃথিবীর দখল নেবে, ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাবে পৃথিবী। তার মতে, এই ঘটনার নামই হলো ''হেল্টার স্কেল্টার''। বিটলস ব্যান্ডের ‘হোয়াইট’ অ্যালবামের জন্য  ‘হেল্টার স্কেলটার’ গানটি লেখা হয়।  স্যার পল ম্যাককার্টনি কুক্ষণেও ভাবেননি যে,এই  গানেরই  এক মারাত্মক অপব্যাখ্যা হবে আর তার ফলে ঘটে যাবে এক নারকীয়  হত্যাযজ্ঞ। নিজেকে আধ্যাত্মিক নেতা দাবি করে ভক্তদের মাথায়ও গানটির এইরকম অবাস্তব মানে  ঢুকিয়ে দেয় ম্যানসন। এরপরে সে এক অদ্ভুত পরিকল্পনায় সামিল করে তার অনুগামীদের, তারা নিজেরাই এই যুদ্ধ শুরু করবে - পরিকল্পনার মূল ছিল এটি এবং নৃশংস  হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে  কালো-সম্প্রদায়ের (বিশেষতঃ নিগ্রো-সম্প্রদায়) মানুষদের  ওপর দোষ চাপানোর ষড়যন্ত্র করে ম্যানসন।
কিন্তু এসবের সাথে শ্যারন টেট আর তার বাকিদের কী সম্পর্ক?  সেটা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার, আসলে তাদের  দুর্ভাগ্য যে তারা ভুল সময়ে ভুল জায়গার শিকার হয়েছিলেন। আসলে ১০০৫০ সিয়েলো ড্রাইভের যে বাড়িটিতে তারা সেই রাতে ছিলেন, ঐ বাড়িতে আগে থাকতেন টেরি মেলচার। এই সেই টেরি মিলচার যিনি ম্যানসনের গায়ক হবার বাসনায় কার্যতঃ জল ঢেলে দিয়েছিলেন, গান নিয়ে  ক্যারিয়ার তৈরির স্বপ্নে  ইতি  টেনে দেবার জন্য বরাবরই একটা আক্রোশ ছিল ম্যানসনের। তাই ঐ বাড়ির লোকদেরই  নিজের শিকার হিসেবে বেছে নেয় সে।







রোমান পোলানস্কি এবং শ্যারন টেট; Image Courtesy: People.com

সেসময়ে রোমান পোলানস্কি আর শ্যারন টেট ছিলেন হলিউডের সেরা দম্পতিদের অন্যতম ( Power Couple)।  হরর কমেডি 'দ্য ফিয়ারলেস ভ্যাম্পায়ার হান্টারস (১৯৬৭)' করার সময়ে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, তার থেকে প্রণয়, যা পরবর্তীতে পরিণয়ে রূপ পায় । ঐদিন স্রেফ ভাগ্যের জোরেই বেঁচে যান পোলানস্কি। আবার ফিরে  আসি সেইরাতের ঘটনায়, ম্যানসন ফ্যামিলির চার সদস্য ঠিক মধ্যরাতে এসে হাজির হয় তাদের বাংলোর সামনে। গাড়ি থেকে বের হয় সুজান অ্যাটকিন্স, প্যাট্রিসিয়া ক্রেনউইনকেল আর ম্যানসনের ডানহাত, চার্লস 'টেক্স' ওয়াটসন। লিন্ডা কাসাবিয়ানকে গাড়িতে রেখে যাওয়া হয় চারিদিকে নজর রাখার জন্য। প্রথমেই ওয়াটসনের হাতে খুন হতে হয়  স্টিভেন প্যারেন্টকে। ফ্রাইকোভস্কি তখন আরাম করে  লিভিং রুমের কাউচে ঘুমাচ্ছিলেন। ঘরে ঢুকে ওয়াটসন তার মাথায় লাথি মারে। ফ্রাইকোভস্কি তার পরিচয় জানতে চাইলে সে জানায়, "আমি শয়তান, নরক থেকে উঠে এসেছি " ( I am Devil, coming from hell) ।টেট, সেবরিং, ফ্রাইকোভস্কি আর ফোলজারকে এক জায়গায় নিয়ে আসে তারা। সেবরিং আর টেটকে সিলিং এর সাথে দড়ি দিয়ে ঝোলানোর সময়ে সেবরিং তাদেরকে অন্তঃসত্তা টেটকে ছেড়ে দিতে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে  সেবরিংকে গুলি করে দেয় ওয়াটসন। এরপরের শিকার ফোলজার,  ওয়াটসন তার পেটে ছুরি চালিয়ে দেয়, একবার নয়, সাতবার। ফ্রাইকোভস্কি কোনোরকমে নিজেকে মুক্ত করে বারান্দার দিকে দৌড় লাগায়, কিন্তু না, শেষ রক্ষা হয়না,  পিস্তলের বাঁট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে ওয়াটসন। তারপরেও তিনি সুইমিং পুল পর্যন্ত পালাতে পেরেছিলেন। কিন্তু ওয়াটসন ছুরির আঘাতে  খুন হতে হয় তাকেও । তাদের চিৎকারে দরজায় উঁকি দেয় কাসাবিয়ান। অন্যদের মত অতোটা নির্মম হতে পারেনি হয়তো সে, তাই দৃশ্যটা পুরোপুরি হজম হয়নি তার। বাকিদের থামানোর জন্য সে একটা মিথ্যা কথা বলে, বলে কেউ যেন একজন আসছে। কিন্তু তারপরেও থামেনি  কাল্ট সদস্যরা। রক্তের খেলায় উন্মাদ তখন তারা। সবথেকে ভয়ানক খুনটা হয়েছিল এরপরেই, বলি হয়েছিলেন টেট, নিজের অনাগত সন্তানের জন্য তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েও বাঁচতে পারেননি তিনি। তাকে ষোলবার ছুরি দিয়ে কোপানো হয়, আর এই নৃশংশ কাজটি নির্বিকার ভাবে  করে ফেলে সুজান। তারপর তারই রক্ত দিয়ে সামনের দরজায় লিখে দেয় 'PIG', সম্ভবত বিটলসের 'পিগিস' গানটির থেকেই এই শব্দটি নেওয়া হয়েছিল।বিটলসের অসাধারণ গানগুলোর কি ভয়ানক অপব্যবহার!







বাড়ির সামনে বসে হতভম্ব পোলানস্কি, দরজায় রক্ত দিয়ে লেখা 'PIG'; Image Courtesy: julian wasser/getty image

পরদিন সন্ধ্যায়, পুরো হলিউড কাঁপিয়ে দিয়ে আরেক দফা আঘাত হানে ম্যানসন ফ্যামিলি। তাদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন লেনো এবং রোজমেরি বিয়াংকা।  লিন্ডাকে নজর রাখার দায়িত্ব দিয়ে তাদের বাড়িতে ঢোকে ওয়াটসন, অ্যাটকিন্স, ক্রেনউইনকেল, লেসলি ভন হুটেন এবং চার্লস ম্যানসন স্বয়ং। তাদের দুজনকে একসঙ্গে বাঁধার কাজটি করলেও খুনের দায়িত্বটি সাগরেদদের হাতেই ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয় ম্যানসন। লেনোর বাড়ির লিভিং রুমের দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা ছিল- "Death to pigs" এবং "Rise"। আর তার রেফ্রিজারেটরের গায়ে লেখা ছিল বিটলসের সেই  বিখ্যাত গান "Healter Skelter"। আলাদা একটি ঘটনায় তাদের নৃশংসতার শিকার হন হলিউডের স্টান্টম্যান ডোনাল্ড শিয়া এবং সঙ্গীতশিল্পী গ্যারি হিনম্যান ।







ম্যানসন ফ্যামিলির হাতে খুন হয়েছিলেন যারা; Image Courtesy : abc7.com

কিন্তু এতগুলো হাই প্রোফাইল খুনের  পরেও ম্যানসন ফ্যামিলি ছিল পুলিশের একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবশ্য কিছুদিনের মাথাতেই ম্যানসন আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা ধরা পড়েছিল গাড়ি চুরির অভিযোগে। কিন্তু তখনও  পর্যন্ত পুলিশ-প্রশাসন তাদের ভয়াবহ অপরাধগুলোর টেরও পায়  নি, তাই শুধুমাত্র গাড়ি চুরির অপরাধে খুব বেশি  শাস্তি পায়নি তারা।  তার কিছুদিন বাদেই  ডেথ ভ্যালির বার্কার র‍্যাঞ্চে কিছু চোরাই গাড়ি আটক হয় আর  তার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ম্যানসন ফ্যামিলির আরোও  কিছু সদস্য ধরা পড়ে। তবে তারাই যে টেট মার্ডারের সাথে জড়িত, সেটা কিন্তু তখনো টের পাওয়া যায় নি। এই ম্যানসনদের জারিজুরি ফাঁস হয় অন্যভাবে। গাড়ি চুরির ঘটনায় জেল হয় সুজান অ্যাটকিন্স-এর, একদিন জেলের অন্য আসামিদের কাছে গর্ব করতে গিয়ে সবকিছু ফাঁস করে বসে সে। এই খবরে নড়েচড়ে বসে পুলিশ-প্রশাসন। চাপের মুখে পড়ে সুজন, পুলিশের ক্রমাগত চাপের মুখে সবকিছু বলতে রাজি হলেও পরে  পিছিয়ে যায়। অবশেষে তদন্ত বড় মোড় নেয় লিন্ডা কাসাবিয়্যানের সাহায্যে। খুনের সময়ে নজরদারির দায়িত্বে থাকা লিন্ডা গা ঢাকা দিয়ে ছিল বেশ অনেকদিন। আত্মসমর্পণ করে সে, বিবেক দংশন নাকি অন্য কিছু! মামলার রাজসাক্ষী হয়, তার সব অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হয়।
অবশেষে, ধরা পড়ে ম্যানসন, অ্যাটকিন্স, ক্রেনউইনকেল এবং ভ্যান হুটেন,  আদালতে হাজির করা হয় তাদের , বিচার শুরু হয় ১৯৭০ সালের ২৪ জুলাই। সেখানেও কিছু অদ্ভুত কান্ড করে তারা- নিজেদের কপাল কেটে 'এক্স' লিখে সবার সামনে হাজির হয়। বিচার চলাকালীন একদিন ম্যানসন পেন্সিল দিয়ে বিচারককে আক্রমণের চেষ্টা করে। অবশ্য প্রথমদিন থেকেই উদ্ভ্রান্ত আচরণ করছিল তারা, মানসিক বিকারগ্রস্থ হিসেবে চিহ্নিত করে জুরি তাদের । ফলে যেটা হয়, তাদের ফাঁসি হবার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়। তাছাড়া ম্যানসনের  সরাসরি এই ঘটনায় জড়িত থাকার  মতো তেমন কিছু প্রমানও পাওয়া যায় নি, কারণ সে নিজের হাতে কোনো খুনিই করেনি। শুধুমাত্র এই নারকীয় খুনগুলির প্রধান  চক্রান্তকারি হিসেবে জড়িত থাকার অপরাধ প্রমাণিত হয় ম্যানসনের বিরুদ্ধে। অতঃপর রায় ঘোষণা করা হয়, এই ভয়ঙ্কর হত্যালীলায় অসহায়ভাবে ভাবে যাদের জীবন শেষ হয়েছিল তারা অবশেষে সুবিচার পায়।  ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ  ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত্যুদণ্ড  নিষিদ্ধ হয়ে গেলে সুপ্রিম কোর্ট তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের  আদেশ দেয়।
এদিকে ১৯৭৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোমান পোলানস্কির প্রবেশ নিষেধ করে দেয়া হয়, তার বিরুদ্ধে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে।







লেসলি ভ্যান হুটেন, সুজান অ্যাটকিন্স ও প্যাট্রিসিয়া ক্রেনউইনকেল; Image Courtesy: Bettmann/Getty Images

২০১৭ সালে ৮৩ বছর বয়সে জেলের  হাসপাতালেই  মারা যায় ম্যানসন। মৃত্যুর আগে দেয়া সাক্ষাৎকারেও নিজের জীবনে বিটলসের গানের প্রভাব নিয়ে এক অদ্ভুত  যুক্তি ছিল তার-  "আমি তো এ গান লিখিনি, লিখেছে বিটলস। এ গানের মধ্যে ওরা বলেছে জেগে উঠতে, খুন করতে, আমার কী করার আছে সেজন্য। গানটির গভীর  অর্থ তো তরুণদের কাছে এমনভাবেই ফুটে উঠেছে।" হেল্টার স্কেলটার নামটা আসলে এসেছে বাচ্চাদের খেলার স্লাইড থেকে, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের  রূপক হিসেবে একে ব্যবহার করেছিলেন ম্যাককার্টনি। কিন্তু মানসিক বিকারগ্রস্থ চার্লস ম্যানসনের কাছে তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পৃথিবী-ধ্বংসের পূর্বাভাস। আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক একটি গান হয়ে দাঁড়ায় ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের অনুপ্রেরণা। 
 ম্যানসন ডুবেছে সবাইকে নিয়ে। গায়ক হতে পারেনি সে, হয়ে গেছে হত্যাকারী, নিজের হাতে একটাও খুন করেনি, তারপরেও ম্যানসন  যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারদের একজন। বিটলসের মতো দুনিয়াজোড়া সাফল্য আর সম্মান পাবার স্বপ্নকেই বিকৃত উপায়ে পূরণ করতে গিয়েছিল সে।

এ ভয়াল হত্যার  কথা বেশ কয়েকবার উঠে এসেছে ছোট এবং বড়পর্দায়। এর মধ্যে নাম করা যায়  ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া 'হেল্টার স্কেল্টার', যেটির ওই একই নামের একটি বইয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। 'আমেরিকান হরর স্টোরি: কাল্ট' সিরিজে দেখা গেছে এই ম্যানসনের চরিত্র।  থ্রিলার 'ব্যাড টাইমস অ্যাট এল রয়্যাল' ছবিতে   ক্রিস হেমসওয়ার্থের চরিত্রটিও ম্যানসনের আদলে লেখা হয়েছে।  ২০১৯ সালে ম্যানসনের চরিত্রটি চারবার হাজির হয়েছে  দর্শকের সামনে- 'চার্লি সেস' কিংবা 'দ্য হন্টিং অফ শ্যারন টেট' নাম করা যায়। তবে দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে কোয়েন্টিন টারান্টিনোর 'ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম... ইন হলিউড' আর ডেভিড ফিঞ্চারের  ক্রাইম থ্রিলার 'মাইন্ডহান্টার' সিরিজ। এ দুটিতে ম্যানসনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন একই অভিনেতা- ড্যামন হেরিম্যান। টারান্টিনোর ছবিতে  তার পাশাপাশি আছেন লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও, ব্র্যাড পিট, আল পাচিনো, মার্গো রবির মতো হলিউডের জনপ্রিয় তারকারা।  'ইনগ্লোরিয়াস বার্স্টার্ডস (২০০৯)' - এই ছবিতে ও মূল ঘটনাকেই একটু অন্যরকম ভাবে পরিবেশন করা হয়েছে।
 ঘটনার ৫০ বছর পরে আজও এই ভয়ানক ঘটনার কথা ভেবে  শিউরে উঠতে হয় ।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস বা মগ্নচৈতন্য / What is Stream of Consciousness?

কাকে বলে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস ? সাহিত্য ধারায় এটি এক রীতি, বলতে গেলে লেখনীর এক ধরণ। সাহিত্যের আলোচনায়  কিংবা সমালোচনায় 'স্ট্রিম অফ কনসাসনেস'- ‘Stream of Consciousness’  বা মগ্নচৈতন্য শুধুমাত্র এক শব্দ নয়, এ এক অনন্য, এক স্বতন্ত্র জঁর  ।  মগ্নচৈতন্যের   স্রোত সাহিত্যসৃষ্টির এক অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন ধারা,  যা কিনা  বিংশ শতাব্দীর কিছু বিখ্যাত লেখক   নিযুক্ত এক স্বতন্ত্র লেখন রীতি। নিজেদের লেখনীতে কিছু ঘটনা পরম্পরাকে  বর্ণনা করতে ব্যবহার করেছিলেন তারা ।  কিন্তু '  মগ্নচৈতন্য '  কী?  কেনই বা  এটি একটি 'ধারা' বা ' জঁর' ?  কিছু  পরিচিতি দিলাম বটে শুরুতে কয়েকটি শব্দকে আশ্রয় করে, তবে  বিস্তারিত আলোচনা  এগোবে আস্তে আস্তে।  এই আপাত সাধারণ এবং একইসঙ্গে ব্যাপকভাবে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা যুক্ত , সাহিত্যিক টার্মটির ধারণা  পরিষ্কার করতে সহায়তা করতে পারে হয়ত এই  আলোচনা ।   Image Courtesy: Steve Jhonson:pixels.com/free image প্রকৃতপক্ষে...

একটি প্রেমের গল্প : অমৃতা প্রীতম এবং সাহির লুধিয়ানভি / The love story of Amrita Pritam and Sahir Ludhianvi

প্রেমের গল্প। প্রেম ভাঙার গল্প। পাত্র-পাত্রী সাহির লুধিয়ানভি এবং অমৃতা প্রীতম। দিকপাল দুই সাহিত্যিক। কেমন ছিল সেই সম্পর্ক ? ''আমি তো জানতাম সাহির, তোমার কোনোদিনই আমার প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো দায় ছিল না । কি যেন বলে আজকাল ! ও হ্যাঁ , কমিটমেন্ট ফোবিয়া।  ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবে কি না সেই দ্বিধাতেই তো রয়ে গেলে। কেন  যেন মনে হয় আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা  সেই গভীরতর  অতলান্ত  স্পর্শ করে নি কোনোদিন। ছুঁয়ে দেখেনি সেই ভালোবাসার তীব্র টানকে। আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবেসেছ  ? যতটা আমি তোমাকে বেসেছি।  "ম্যায়নে টুট  কে প্যায়ার কিয়া তুম সে / ক্যায়া  তুমনে ভী উতনা কিয়া মুঝ সে?'' অমৃতা প্রীতম এবং সাহির লুধিয়ানভি : Image Courtesy : Indian Express  ' ''মোহাব্বত কি পরখ  কা  ইয়েহি  তো রাস্তা  হ্যায় / তেরি  তালাশ মে নিকলু, তুঝে  না  পায়ু  ম্যায় '' । অমৃতা ভালোবাসা খুঁজেছেন, সেই আকুল করা ভালোবাসা,  হৃদয় তন্ত্রীতে সেই তীব্র...

ভারতে পিকনিকের খাবারের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস / The Diverse History Of Picnic Food In India

  ভারতে পিকনিকের খাবারের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস / The Diverse History Of Picnic Food In India ভারতে  কিরকম ভাবে হয় পিকনিক। কিভাবেই বা হতো ব্রিটিশ আমলের পিকনিক? মহাভারতের যুগেও কি হতো পিকনিক?  পিকনিক: Image Courtesy: Getty Image  মহাভারত থেকে ব্রিটিশ রাজ - বাড়ির বাইরে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া , না, না কোনো রেস্তোরাঁর কথা বলছি না, বলছি পিকনিকের (picnic) কথা,  বাংলায় চড়ুইভাতি বলি যাকে। ছোটবেলার পিকনিকের স্মৃতি রাজত্ব করছে এখনও,আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু যুগের ঐতিহ্য এই চড়ুইভাতি এখনও টিকে আছে বহু বদলের পরেও।  শুধুমাত্র মেনু পরিবর্তিত হয়েছে,পরিবর্তিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর চরিত্র, ভৌগলিক দূরত্বের সাথে আলাদা হয়েছে বিভিন্ন  চড়ুইভাতির রকম - সকম, খাবারের মেনুর। আশি কিংবা নব্বই দশকের প্রকাশিত হওয়া কোনো গল্পের সিরিজে, সিরিয়ালে, উপন্যাসে, কিংবা রম রম করে  হল গুলোতে চলা সিনেমাতে  পক্ষে মেয়েদের রঙিন মাসিক পত্রিকাতে  পিকনিকের উল্লেখ , ছবি থাকতই থাকত। বড় বেলায় দেখে ছোটবেলার পিকনিকের ছবি। কিন্তু  একটা জিনিস নিয়ে দুঃখ আমার বরাবরই থেকে...